রঙ্গব্যঙ্গ-ছাত্রলীগ-আতঙ্ক! by মোস্তফা কামাল

লোকটা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। কিছুক্ষণ পর পর তিনি পেছনের দিকে তাকাচ্ছেন আর দৌড়াচ্ছেন। তাঁকে কি কেউ তাড়া করছে নাকি ভয়ে-আতঙ্কে তিনি দৌড়াচ্ছেন! আশপাশের লোকজন ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না। ব্যাপারটা তাদের কাছে রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে।


লোকটার জামা-কাপড় ঘামে ভিজে চপচপে হয়ে গেছে। দূর থেকে তাঁর নিঃশ্বাস ওঠানামার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ লোকটাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তিনি থামছেন না। একজন পথচারী লোকটাকে জোর করেই থামালেন। তারপর জানতে চাইলেন, আচ্ছা ভাই, আপনি এভাবে দৌড়াচ্ছেন কেন? কী হয়েছে?
এবার লোকটা দাঁড়ালেন। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছেন না। তিনি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁর প্রচণ্ড পানির পিপাসা লেগেছে। পথচারী তাঁকে ধরার পর কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে ফুটপাতের ওপর বসে পড়লেন। এর মধ্যে পথচারী লোকটা আরেকবার তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ভাই, সমস্যা কী?
'আরে ভাই ছাড়েন তো! এই বয়সে মার খেয়ে মরতে চাই না।'
'কেন কী হয়েছে?'
'আর বলবেন না। এমন দৌড়ানি আমি জীবনে খাইনি!'
'কে, কেন দৌড়ানি দিল?'
'আমাকে তাদের কথামতো চলতে হবে। তারা যা বলবে তা শুনতে হবে। আচ্ছা ভাই, আপনিই বলেন, এটা কি সম্ভব?
'আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কাদের কথামতো চলতে হবে?'
'ছাত্রলীগ! ছাত্রলীগ! দেখেন তো, এদিকে আসছে কি না?'
'আরে দাঁড়ান না! এত ভয় পাচ্ছেন কেন?'
'ওদের সঙ্গে ঝামেলায় তো পড়েননি! পড়লে বুঝতেন! আমি গেলাম!'
'আরে ভাই, আপনি এমন করছেন কেন?'
'ওরা দেশটারে যে কী পাইছে! তারা কোথায় পড়াশোনা করবে তা না, কোথায় টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি আছে সেখানে গিয়ে উল্টাপাল্টা কাজ শুরু করেছে।'
'তাতে আপনার সমস্যা কী?'
'আরে ভাই, আমি সমস্যায় পড়েছি বলেই তো বলছি।'
'কী সমস্যায় পড়েছেন?'
'আমার নাম ওয়াহেদ মিয়া। আমি শিক্ষা অধিদপ্তরে উপপরিচালক হিসেবে চাকরি করি। ছাত্রলীগের ছেলেরা কয়েকজন শিক্ষকের বদলির জন্য তদবির করতে এসেছে। আমি বলেছি, নিয়মের বাইরে আমি কিছু করতে পারব না। তারা বলল, তাদের কথামতো কাজ করতে হবে। অন্যথায় আমাকেও বদলি করে দেবে। আমি বললাম, ঠিক আছে, বদলি করতে পারলে করুন। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। তেড়ে এল আমাকে মারতে। আমি পড়িমরি করে দিলাম দৌড়। ওরাও আমার পিছু নিল।'
'ওহ, এই কথা! আগে বলবেন তো!'
'এই কথা বলতেই তো চেয়েছিলাম। আপনি সুযোগ দিলেন কোথায়?'
হঠাৎ ওয়াহেদ মিয়া দেখলেন কয়েকজন যুবক একসঙ্গে হেঁটে আসছে। তিনি ভাবলেন, এরাই বুঝি সেই ছাত্রলীগের ছেলে! তিনি বললেন, 'ওই তো, আবার আসছে! ভাই সাহেব, আমি গেলাম! দোয়া করবেন, যেন মাইরের হাত থেকে রক্ষা পাই!'
ওয়াহেদ মিয়া আবার দৌড় শুরু করলেন। তাঁর দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন পথচারী লোকটি।
২.
ডা. এম এ আজহার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ। নিরীহ গোবেচারা টাইপের মানুষ! নিয়োগ লাভের পর তিনি প্রথম কলেজে এসেছেন। নতুন দায়িত্ব বুঝে নেবেন। কিন্তু কলেজ আঙিনায় পা দেওয়ার পর তিনি আর সামনে এগোতে পারছিলেন না। পেছন থেকে কয়েকজন তাঁর দুই হাত টেনে ধরল। থতমত খেয়ে গেলেন তিনি! একটু ভয়ও পেলেন। ভয়ে ভয়ে তিনি তাদের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, 'কী ব্যাপার! আপনারা কারা?'
'আমরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।'
নাম শুনেই আজহার সাহেবের পিলে চমকে গেল। তিনি কাঁপতে শুরু করলেন। কাঁপতে কাঁপতে বললেন, 'কী হয়েছে, বাবা! আমাকে কী করতে হবে! তোমরা যা বলবে, আমি তা-ই করব!'
'আপনি যেখান থেকে এসেছেন, সেখানে ফিরে যান। এই কলেজে আপনি ঢুকতে পারবেন না।'
'ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে! আমি চলে যাব। আমার জয়েনিংটা শুধু দিয়ে যাই। তা না হলে তো আমার চাকরি নট হয়ে যাবে!'
'আপনাকে যা বলেছি তাই করেন। তা না হলে আমাদের ব্যবস্থা আমরা করব।'
'সেটা কি দেখতে চান?'
'না না, ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি!'
আজহার সাহেব নিরুপায় হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে কলেজের উপাধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা। তিনি তাঁকে দেখে বললেন, 'আরে স্যার, আপনার না আজ জয়েনিং? আপনি কোথায় যাচ্ছেন?'
আজহার সাহেব বললেন, 'না না, কিসের জয়েনিং!'
'আমাকে তো মিনিস্ট্রি থেকে বলল, আজ আপনার জয়েনিং।'
'আমার জয়েনিংয়ের দরকার নেই। আমি যাই।'
'কেন কী হয়েছে, কোনো সমস্যা?'
'সমস্যার কথা আর কী বলব! আমি তো জয়েন করার জন্যই এসেছিলাম। কিন্তু ছাত্রলীগের ছেলেরা আমাকে ঢুকতে দিল না। বলল, আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানেই যেন চলে যাই।'
'তাই নাকি! আপনি আমার সঙ্গে আসেন। দেখি কী করা যায়!'
এবার তাঁরা দুজন কলেজের ভেতরে ঢুকতে গেলেন। তাঁদের দেখে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ধর ধর করে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসে। ভয়ে-আতঙ্কে তাঁরা দৌড় শুরু করেন।
সে কী দৌড়!

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.