পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিত ও বাংলাদেশ by আবু এন এম ওয়াহিদ

১৯৯২ সাল। আমি তখন ইস্টার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। ওই বছরের স্প্রিং সেমিস্টারে ইউনিভার্সিটি কন্টিনিউইং এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের অধীনে আমাকে একটি বাড়তি কোর্স দেওয়া হলো। পড়াতে যেতে হতো অফ ক্যাম্পাস- আমাদের হোম টাউন চার্লস্টন থেকে প্রায় ৬০ মাইল উত্তরে শ্যানুট এয়ারফোর্স বেসে।


'ইউএস-জাপান ট্রেড রিলেশনসে'র ওপর এটি ছিল একটি বিশেষ ধরনের নতুন কোর্স। সপ্তাহে এক দিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ক্লাস চলত। ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা সবাই ছিল ইউএস এয়ারফোর্সের অফিসার। তাদের অনেকে আবার বিভিন্ন মেয়াদে জাপানের ওকিনাওয়ায় ডিউটি করে এসেছে। এমনি একজন ছাত্র (দুঃখিত, তার চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে; কিন্তু নামটি মনে পড়ছে না) আরবানা-শ্যাম্পেইন 'ইউএস-জাপান হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের' সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
একই বছর এপ্রিল-মে মাসের কোনো এক দিন, ওই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে 'ইউএস-জাপান ট্রেড রিলেশনসে'র ওপর শ্যাম্পেইনে একটি বিতর্কসভার আয়োজন করা হলো। আমার সে ছাত্রের সুপারিশের ভিত্তিতে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় আরবানা-শ্যাম্পেইনের ফিন্যান্সের অধ্যাপক ড. ব্রায়ান উইলিয়ামসের বিপরীতে ওই বিতর্কে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। ড. ব্রায়ান উইলিয়ামস একটি বড় ও নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান সিনিয়র প্রফেসর আর আমি মাত্র পিএইচডি শেষ করে একটি ছোট স্টেট স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছি। বিতর্কে তাঁর সামনে আমি কেমন করে দাঁড়াব? ২০০ ডলার সম্মানীর আশায় সাত-পাঁচ না ভেবে দাওয়াত পাওয়া মাত্র কবুল করে ফেললাম। কিন্তু বিতর্কের আগে প্রস্তুতি পর্বে গিয়ে বুঝতে পারলাম, যে কাজটি করতে যাচ্ছি, তা একেবারে ছেলেখেলা নয়। জীবনের প্রথম দ্বিপক্ষীয় উন্মুক্ত বিতর্ক, তাও আবার সমানে সমানে নয়, রুই-কাতলার সঙ্গে চুনোপুঁটির।
যদিও বেশ নার্ভাস লাগছিল, তবু মনে মনে ঠিক করলাম, 'হ্যাঁ' যখন একবার বলেই ফেলেছি, 'না' আর করব না। যথাসাধ্য প্রস্তুতি নিয়ে যাব। দেখা যাক কী হয়? আল্লাহ ভরসা! ঘটনার দিন সময়মতো যথাস্থানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ছোট্ট অডিটোরিয়াম। হল ভর্তি মানুষ। ড. উইলিয়ামসের পাশে যখন গিয়ে ডায়াসে বসলাম, তখন বুঝতে পারলাম হৃদস্পন্দন অনেক বেড়ে গেছে। মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে।
বিতর্ক চলাকালে অধ্যাপক ব্রায়ান উইলিয়ামস অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন। তার মধ্যে যে তথ্যটি আজকের নিবন্ধের জন্য প্রাসঙ্গিক, তা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি। বিতর্কের একপর্যায়ে প্রশ্ন উঠেছিল, উন্নয়নশীল বিশ্বে শিক্ষা, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবকাঠামোর জন্য সবচেয়ে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ প্রয়োজন; কিন্তু পৃথিবীর উদ্বৃত্ত পুঁজি সেসব দেশে না গিয়ে যুগ যুগ ধরে স্রোতের মতো আমেরিকায় ধেয়ে আসছে কেন? অধ্যাপক উইলিয়ামস এর একটি সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'পুঁজি যখনই যেখানে যায়, যাওয়ার আগে তার নিরাপত্তা চায়। নিরাপত্তার পরেই আসে মুনাফার প্রশ্ন, এর আগে নয়।' তিনি আরো বলেছিলেন, 'গত ২০০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আমেরিকা কোনো দিন কোনো বড় যুদ্ধে হারেনি। তার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রয়েছে দৃঢ় সুস্থিত স্থিতাবস্থা। ৫০ বছর পর কোন দিন আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে, তা আজই সুনির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া যায় এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পর শান্তিপূর্ণভাবে যে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে, তাও মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এ দেশের সমাজে বড় ধরনের কোনো অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা নেই। আছে একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর সামাজিক ভারসাম্য। এখানে আছে শক্ত আইনের শাসন এবং উন্নত ও ন্যায়নিষ্ঠ বিচারব্যবস্থা। এ দেশের ব্যাংকিং এবং অর্থব্যবস্থাও শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মোট কথা আমেরিকার সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন-আদালত ও রাষ্ট্রকাঠামো মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী। এগুলো কোনো বিদেশি শক্তির পদানত হওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই। এসব কারণে আমেরিকার বাজার বিশ্বপুঁজির জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। আর তাই শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে চীন, জাপান, রাশিয়া, ক্যারিবিয়ান, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর যাবতীয় উদ্বৃত্ত পুঁজি অনবরত ছুটে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।'
যে কথা সে দিন ড. উইলিয়ামস বলেননি তা হলো, প্রতিবছর পৃথিবীতে যত সম্পদ সৃষ্টি হয়, তার এক-চতুর্থাংশের অংশীদার একা আমেরিকানরাই। তাবত পৃথিবী জাতীয় নিরাপত্তায় যা খরচ করে থাকে, ঘোষিত এবং অঘোষিতভাবে আমেরিকা একাই তার সমপরিমাণ করে থাকে। সুতরাং সম্মুখসমরে আমেরিকাকে হারানোর শক্তি অন্য কোনো দেশ রাখে না। এসব বিশেষণ যুগ যুগ ধরে আমেরিকার জন্য প্রযোজ্য হয়ে আসছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এসব স্বতঃসিদ্ধ কথায় আস্তে আস্তে চিড় ধরতে শুরু করেছে। ২০০০ সালের নির্বাচনে ফ্লোরিডায় ভোট গণনা নিয়ে যা হলো, তা নিতান্তই অভূতপূর্ব। জর্জ ডাব্লিউ বুশ এবং আল গোরের নির্বাচন শেষ পর্যন্ত ব্যালটে নয়, কোর্ট অর্ডারে ফয়সালা হলো। আমেরিকার শত শত বছরের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের জন্য এ এক কলঙ্ক ছাড়া আর কিছু নয়। পরের বছর ৯/১১-এর মতো মর্মান্তিক ঘটনাকে আমেরিকার মতো সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র ও তার গোয়েন্দা বিভাগ ঠেকাতে পারেনি। পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে সরকারি হিসাবে দেখানো হচ্ছে- বেকারত্বের হার ৯ দশমিক ১ শতাংশ, কিন্তু আসলে এটা ১৪ শতাংশের ওপরে। দেশের তিন কোটি কর্মক্ষম মানুষ বছরের পর বছর ধরে বেকার। সীমাহীন ফোরক্লোজারের কারণে লাখ লাখ পরিবার বাড়িঘর হারিয়ে পথে বসেছে। জোড়াতালি আর ধামাচাপা দিয়ে ভুক্তভোগী জনগণকে সরকার বুঝিয়ে শান্ত রাখতে পারছে না। দৈনন্দিন বিল পরিশোধ করতে না পেরে সাধারণ জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তারা রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করেছে। শুরু হয়েছে 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলন। দিন দিন এ আন্দোলনের আগুনে হাওয়া লাগছে। পুলিশের সঙ্গে প্রতিদিন বিক্ষোভকারীদের বচসা হচ্ছে, হাতাহাতি হচ্ছে, মারামারি হচ্ছে। সে দিন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া-বার্কলের এক ছাত্র মারাও গেছে। অসহিষ্ণু জনগণ ধীরে ধীরে রীতিমতো মারমুখী হয়ে উঠছে। দেখে যত দূর মনে হচ্ছে, আলামত ভালো নয়। এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোয় উপর্যুপরি আঘাত লাগছে। পরিস্থিতি কখন কোন দিকে কী ধরনের মোড় নেয় বলা মুশকিল।
১৯৯২ সালে অধ্যাপক ব্রায়ান উইলিয়ামসের ভাষায় আমেরিকায় যেটা ছিল অসম্ভব, আজ মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে তা সম্ভব হয়ে উঠতে শুরু করেছে। জানা কথা নতুন করে আবার উপলব্ধি করছি, আল্লাহ ছাড়া এ পৃথিবীতে কোনো মানুষ, এমনকি কোনো ব্যবস্থাই চিরস্থায়ী নয়। সবই ক্ষণস্থায়ী, সবই ভঙ্গুর। ২২৫ বছরের একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রের সুস্থ সমাজ, রাজনীতি, সমরনীতি ও অর্থনীতি অসুস্থ ও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। তবে এ পরিবর্তন হঠাৎ এবং আপনাআপনি হচ্ছে না। অনেক দিন ধরে এ পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হচ্ছিল। এখন পরিপূর্ণ হয়ে তার ফলাফল প্রকাশ করতে শুরু করেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে একটি ভালো, স্থিতিশীল এবং সুন্দর অবস্থাকে যুগ যুগ ধরে টিকিয়ে রাখতে হলে দেশ ও দেশের জনগণকে ক্রমাগত সঠিক নীতি ও সঠিক কাজটি করে যেতে হয়। তা না হলে স্থিতাবস্থায় ক্ষয় অনিবার্য। আর তাই ঘটছে আজকের আমেরিকায়।
এখানে একটা কথা বুঝে রাখা প্রয়োজন, উপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যার অভাবে যদি একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে, তাহলে একই যুক্তিতে উপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে একটি ভেঙে পড়া ব্যবস্থাকে কেন সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলা যাবে না! পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাচ্ছি। আমি আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের কথাই বলছি। শত শত বছরের স্থিতিশীল মার্কিন সমাজে যদি ভেঙে পড়ার চিড় দেখা দেয়, তাহলে মাত্র ৪০ বছরের বাংলাদেশের অসুস্থ সমাজ ও রাজনীতি কেন সুন্দর ও সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে না। পরিবর্তন যেমন ভালোকে খারাপ করতে পারে, তেমনি খারাপকেও তো ভালো করতে পারে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ কবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভালোকে আলিঙ্গন করার জন্য আন্তরিকতা নিয়ে চেষ্টা করতে শুরু করবে? আমার মনে হয়, এটাই এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হওয়া উচিত।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি ও এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.