প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরঃ নাকের বদলে নরুণ পেলাম by আবুল কালাম আজাদ

গত ১০-১৩ জানুয়ারি, ২০১০ সময়কালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছিলেন। ১১ জানুয়ারি দুই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১২ জানুযারি বৈঠকের ফলাফল সংবলিত ৫০ অনুচ্ছেদের যৌথ ইস্তেহার প্রকাশিত হয়।

সফরশেষে দেশে ফিরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, তার সফর শতভাগ সফল হয়েছে। অপরপক্ষে বিরোধীদল বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে। দু’পক্ষের দাবি-পাল্টাদাবি নিয়ে দেশের সিংহভাগ মানুষ মোটেও বিস্মিত হননি। কারণ সরকারি দল সফলতা দাবি করবে, বিরোধীদল ব্যর্থ বলবে—এটাই তো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সচেতন জনগণ ঠিকই দেশের স্বার্থ বোঝে এবং তারা সময়মত এর মূল্যায়ন করবেন। তবে এটা ঠিক, সফরের আগে যেভাবে ঢাকঢোল পেটানো হয়েছে, তাতে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তাই সেই প্রত্যাশায় প্রাপ্তি কতটুকু বা কিসের বদলে কি পেলাম তা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। যৌথ ইস্তেহারের ৫০ অনুচ্ছেদের মধ্যে ১৩ থেকে ৪৩ ও ৪৭-৪৮ অনুচ্ছেদসমূহে দুই দেশের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটির আলোচনা করতে চাই।
১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কূটনৈতিক ও কনসুলার উপস্থিতি জোরদার করা হবে। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে সেবার উদ্যোগই মনে হবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে কনসুলার উপস্থিতির নামে ভারতের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তাকর্মীর উপস্থিতিই বাড়বে। ভারত কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে তাদের মিশনের নিরাপত্তার নামে নিজেদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ঢাকায় আনার কথা বলে আসছে। কয়েকদিন আগে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল এ সংক্রান্ত সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করে। এতে সরকার কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। সম্ভবত এটি জায়েজ করতেই এ সিদ্ধান্তের অবতারণা।
১৮ অনুচ্ছেদের মর্মকথা, দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী সংযত আচরণ করবে এবং আন্তঃসীমান্ত অবৈধ কার্যকলাপ ও প্রাণহানিরোধে তাদের নিয়মিত বৈঠক করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। দুঃখের বিষয়, দুই প্রধানমন্ত্রী যেদিন এই সিদ্ধান্ত নেন সেদিনও বিএসএফ একজন বাংলাদেশীকে খুন করেছে। এই অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে, ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ-ভারত উচ্চপর্যায়ের প্রতিটি বৈঠকে এই একই ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিডিআর (বর্তমান নাম সম্ভবত বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ) সবসময় সংযত আচরণ করলেও ট্রিগার হ্যাপি বিএসএফ অব্যাহতভাবে নিরীহ বাংলাদেশীদের ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে আসছে, যা মানবাধিকারের নির্লজ্জ লঙ্ঘন। কেউ যদি অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার করে, তাহলে তাকে গুলি করে হত্যা না করে গ্রেফতার করে বিচারে সোপর্দ করা হবে—এমন একটি সিদ্ধান্ত এদেশের জনগণের প্রত্যাশিত ছিল; কিন্তু তা হয়নি।
১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা গান্ধী চুক্তির আলোকে স্থলসীমানা সংক্রান্ত সব বিষয় নিষ্পত্তি করতে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা ডাকতে সমঝোতা হয়েছে (অনু. ২০)। ১৯৭৪ সালের পর থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত অনেকবার হয়েছে এবং যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সভাও অনেক হয়েছে, কিন্তু ভারতের একগুয়েমির কারণে অদ্যাবধি স্থলসীমানা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সমুদ্রসীমা বিরোধ বন্ধুত্বপূর্ণভাবে মীমাংসা করার প্রয়োজনীয়তা (ঘববফ) স্বীকার করা হয়েছে (অনু. ২১)। বাংলাদেশ সবসময়ই তাই চেয়েছে, কিন্তু ভারত বাংলাদেশের দাবি উপেক্ষা করে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সমুদ্রসীমাও তারা একতরফাভাবে নির্ধারণ করে বাংলাদেশের কিছু অংশ দাবি করছে।
আশুগঞ্জ ও শিলঘাটকে পোর্ট অব কল ঘোষণা করা হবে (অনু. ২২)। এতে বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ নেই বললেই চলে। আশুগঞ্জ নৌবন্দরের মাধ্যমে ভারত পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা যাতায়াতের করিডোর পেল। ঠিক এই একই লক্ষ্যে আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত রেলযোগাযোগ স্থাপন করা হবে (অনু. ২৪)। বাংলাদেশ ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দিতে সম্মত হয়েছে এবং সড়ক ও রেলপথে ভারতের মালামাল ওই দুই বন্দরে আনা-নেয়া করা যাবে (অনু. ২৩)। এর মাধ্যমে ভারতকে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য ট্রানজিট দেয়া হলো। মজার ব্যাপার হলো, নেপাল ও ভুটান চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে কিনা তার নিশ্চয়তা ভারত দেয়নি, বাংলাদেশ শুধুু ইচ্ছা প্রকাশ করেছে মাত্র। বাস্তবতা হলো, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের বর্তমান অবকাঠামো, ফ্যাসিলিটি ও জনবল যেখানে বাংলাদেশের রফতানি-আমদানি হ্যান্ডল করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে ভারতের মালামাল সামলাবে কীভাবে?
যৌথ ইস্তেহারের ২৭ অনুচ্ছেদে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের আলোচনা তাড়াতাড়ি শেষ করতে বলা হয়েছে। আলোচনা শেষ করার বা চুক্তি সম্পাদন করার কোনো টাইম ফ্রেম দেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে জেআরসি’র সভা অতীতের মতো কোনো অগ্রগতি ছাড়াই চলতে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বাংলাদেশ থেকে আমদানি উত্সাহিত করতে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূরীকরণে সমঝোতা হয়েছে (অনু. ৩২)। খুবই ভালো কথা। ২০০১-২০০৩ সময়কালে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক ফোরামে ভারতের সঙ্গে আমার নিগোসিয়েশনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, এ ধরনের আশ্বাস ভারত বরাবরই দিয়েছে কিন্তু বাস্তবায়ন করেনি। আমাদের রফতানিকারকদের অন্যতম দাবি ছিল পণ্যমানের ক্ষেত্রে ভারত যেন বিএসটিআই’র সার্টিফিকেট গ্রহণ করে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সফরে তার সুরাহা হয়নি, হলে একটি অশুল্ক বাধা দূর হতো। বলা হলো, প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ভারত বাংলাদেশের আরও ৪৭টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে, কিন্তু তার কোনো উল্লেখ ইস্তেহারে নেই। সাফটার আওতায় এলডিসি’র জন্য ভারতের নিগেটিভ লিস্টে প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রাক্কালে ৪৮০টি পণ্য ছিল, যেগুলোতে বাংলাদেশের রফতানি সক্ষমতা রয়েছে। ওই ৪৮০টি থেকে ৪৭টি পণ্য কমিয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। ওয়াকিবহাল মহল বলছে ৪৭টি পণ্যের বিষয়টি আই ওয়াশ ও প্রচারণা মাত্র। উল্লেখ্য, সাফটার আওতায় ওই সুবিধা শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, আফগানিস্তান, ভুটান, নেপাল ও মালদ্বীপের জন্যও প্রযোজ্য। এতে প্রধানমন্ত্রী ও তার মেগা ডেলিগেশনের কোনো কৃতিত্ব নেই।
নেপাল ও ভুটান থেকে আগত ট্রাকগুলোকে বাংলাবান্ধা স্থল কাস্টমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ২০০ মিটার পর্যন্ত আসতে দিতে ভারত রাজি হয়েছে (অনু. ৩৭)। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কোনো ট্রাককে নেপাল ও ভুটানে যেতে দেয়া হবে কিনা তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি।
ভারত বাংলাদেশকে রেলওয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন ও বাস সংগ্রহে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে (অনু. ৩৮)। এটি সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বলেই মনে হচ্ছে। এতে সুদের হার ও অন্যান্য শর্তাবলি কী হবে তা এখনও জানা যায়নি। বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নিরুত্সাহিত করে আসছে, কারণ এতে সুদের হার বেশি থাকে এবং এর মাধ্যমে সংগৃহীত মালামাল ও সম্পাদিত কাজ মানসম্পন্ন হয় না।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে ভারতের প্রার্থিতায় সমর্থন জানানোর ঘোষণা দিয়েছে (অনু. ৪৭)। কিন্তু ঢাকায় বিমস্টেক সচিবালয় স্থাপনে সমর্থন দেবে কিনা ভারত তা বিবেচনা করে দেখবে (অনু. ৪৩)। আমরা সরাসরি সমর্থন জানালাম আর তারা বিবেচনা করে দেখবে, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি বলে কথা।
এখন দেখা যাক, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে বাংলাদেশ ভারতকে কী দিল বা ভারত কী পেল। এক. যে চুক্তিগুলো করা হয়েছে তার মাধ্যমে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংহত হবে, দুই. ভারত সড়ক ও রেলপথে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর হয়ে বহির্বিশ্বে ট্রানজিট পেল, তিন. নৌপথে আশুগঞ্জ হয়ে সড়ক ও রেলপথে আগরতলা যাওয়ার করিডোর পেল, চার. নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার সমর্থন পেল, পাঁচ. বিদ্যুত্ বেচার বাজার পেল (অনু. ৩১), ছয়. সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট দেয়ার নামে আরও বাজার সুবিধা পেল ইত্যাদি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়েতে যোগদানের মাধ্যমে (যা গত বছরের ৮ নভেম্বর থেকে কার্যকর) ভারতকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মেঘালয়-আসাম ইত্যাদি রাজ্যে যাওয়ার করিডোর ইতোপূর্বে দেওয়া হয়েছে; তাই এ বিষয়টি আর এই সফরে আলোচিত হয়নি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ কী পেল তা দেখা যাক—এক. ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানির সুবিধা। তবে এই সুবিধা আগামী ২-৩ বছরে পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, কারণ বিদ্যুত্ সঞ্চালনের কোনো অবকাঠামোই বর্তমানে নেই, দুই. এক বিলিয়ন ডলারের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট যা বাংলাদেশ নীতিগতভাবে নিরুত্সাহিত করে আসছে, তিন. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তি যা যা তার ব্যক্তিগত অর্জন, চার. স্বাক্ষরিত চুক্তির ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে, কারণ সেভেন সিস্টারের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর আক্রমণের টার্গেট হতে পারে বাংলাদেশ। তারপরও প্রধানমন্ত্রী দাবি করে বলেছেন, ‘জয় চেহেছিনু, জয় পেয়েছি, জয়ী আমি আজ।’ সত্যিই কি তাই? যৌথ ইস্তেহার পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ নাকের বদলে নরুণ পেয়েছে।
লেখক : সাবেক সচিব

No comments

Powered by Blogger.