চরাচর-রমনা পার্কের বিবর্ণ চিত্র by অনিক

রাজধানীবাসীর একটু মুক্ত, নির্মল, প্রাকৃতিক বাতাস, নিরিবিলি পরিবেশ পাওয়ার প্রত্যাশা ক্রমেই প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতার নিচে চাপা পড়ছে। ঐতিহ্যবাহী রমনা পার্ক মহানগরবাসীর কাছে নানা কারণে গুরুত্ববহ একটি ক্ষেত্র হলেও এর দুরবস্থা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। শান্তিপ্রিয় মানুষের পক্ষে সেখানে যাওয়া যেন দুরূহই হয়ে পড়ছে।


আর কয়েক দিন পরই রমনা বটমূলে ঐতিহ্যবাহী বাংলা নববর্ষের আড়ম্বরপূর্ণ বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে প্রতিবারের মতো এবারও। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আমাদের এই নগরজীবনের একটি আলোকিত অধ্যায়। তা ছাড়া প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে রমনার গুরুত্ব ও আকর্ষণ একসময় দুটোই অনেক বেশি থাকলেও ক্রমেই তা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। সান্ধ্যভ্রমণ, প্রাতঃভ্রমণকারীরাও বাধ্য হয়ে রমনা ত্যাগ করতে চলেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাই ও অসামাজিক কাজকর্ম অনেক বেড়ে গেছে। যেসব পথচারী ওদিকে গেলেই রমনাকে বেছে নিতেন খানিক সময়ের জন্য বিশ্রামের ক্ষেত্র হিসেবে, এখন তাঁরাও সংগত কারণেই সে চিন্তা বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। সমাজবিরোধীদের অপতৎপরতা সব কিছু থামিয়ে দিচ্ছে। রমনার পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা হয়ে পড়েছে। রমনা পার্কের বড় অংশজুড়ে রয়েছে একটি লেক, যা রমনা লেক নামে পরিচিত। সেটির দুরবস্থাও চোখে পড়ার মতো। ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হয়ে উঠেছে এটি। ৮.৭৬ একরের লেকটি দুই ভাগে বিভক্ত। শৈল্পিকভাবেই লেকটি গড়ে তোলা হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম বড় বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। লেকের পাড়ে অবস্থিত পাকা বেঞ্চগুলোর দশাও করুণ। সেগুলোতে রয়েছে ময়লা-আবর্জনার ছোপ ছোপ ছাপ। দেখাশোনার যেন কেউ নেই। টয়লেটগুলোর অবস্থা আরো করুণ। রমনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তিনটি বিভাগ। সংশ্লিষ্টদের কাছে এমন অভিযোগ নিয়ে গেলে তারা জানায়, অভিযোগ সত্য নয়। তাদের বক্তব্য, রমনার পরিবেশ রক্ষার্থে সব কিছুই তারা ঠিকঠাক করছে। তাদের বক্তব্য যে কত অসার, তা রমনা পার্কে ঢোকা মাত্রই বোঝা যায়। ১৬১০ সালের গোড়ার দিকে মোগলরা এ রমনা পার্ক গড়ে তুলেছিল। ঢাকা থেকে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হওয়ার পর রমনা একটি জঙ্গলে পরিণত হয়। ১৮২৫ সালে তদানীন্তন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডচ রমনার জঙ্গল পরিষ্কারের উদ্যোগ নেন। এর দীর্ঘদিন পর ১৯০৮ সালে লন্ডনের কিউ গার্ডেনের অন্যতম প্রধান বাগানকর্মী আর এল প্রাউডলকের সহায়তায় নতুনভাবে সাজানো হয় রমনাকে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাঙালি অখিল বাবু নামের একজন। তাঁরা দুজন প্রায় দুই দশক চেষ্টা চালিয়ে রমনার একটি সুন্দর রূপ দেন। ১৯৪৯ সালে রমনাকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৫২ সালে রমনাকে আরো আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখানে রয়েছে নাগলিঙ্গম, অর্জুন, মহুয়া, তেলসুর, অশোক, কর্পূর, রিটা, নাগেশ্বর, স্বর্ণচাঁপাসহ নানা প্রজাতির বৃক্ষ। গবেষক ও বৃক্ষপ্রেমীদের কাছে রমনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। কিন্তু এটি ক্রমেই শ্রীহীন হয়ে পড়ছে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা ও কর্তব্য পালনে অনীহার কারণে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এসব বিষয় অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে তারাও নির্বিকার! জবাবদিহিতা-দায়বদ্ধতার পাঠ যদি এভাবে চুকে যেতেই থাকে তাহলে গত্যন্তর কী? রমনার শ্রী ফিরিয়ে এর পরিবেশ সুস্থ করার উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা কি এ ব্যাপারে তৎপর হবেন?
অনিক

No comments

Powered by Blogger.