'পরিবর্তনকে অস্বীকার করা যাবে না'

১৯ মে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রশ্নে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ দুই কিস্তিতে কালের কণ্ঠের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো। প্রথম কিস্তি পড়ুন আজ। সবাইকে ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনারা দয়া করে বসুন।


আমি প্রথমেই হিলারি ক্লিনটনকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরু করতে চাই, যিনি গত ছয় মাস সফর করে নতুন ল্যান্ডমার্ক সৃষ্টি করেছেন। আকাশপথে তিনি ১০ লাখ মাইল ভ্রমণ করেছেন। আমি প্রতিদিন তাঁর খোঁজ রেখেছি। আমার বিশ্বাস, তিনি আমাদের ইতিহাসের অন্যতম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন।
আমেরিকার কূটনীতির নতুন অধ্যায় বর্ণনা করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হলো উপযুক্ত জায়গা। গত ছয় মাসে আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় আমূল পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি। চৌহদ্দি থেকে চৌহদ্দি, শহর থেকে শহর, দেশ থেকে দেশে জনগণ জেগে উঠেছে মানবাধিকারের দাবিতে। দুজন নেতা ইতিমধ্যে সরে দাঁড়িয়েছেন। হয়তো আরো অনেকে সে পথ অনুসরণ করবেন। যদিও এ দেশগুলো আমাদের উপকূল থেকে ভৌগোলিকভাবে অনেক দূরে, কিন্তু আমরা জানি অর্থনীতি এবং নিরাপত্তা, ইতিহাস ও বিশ্বাসের প্রশ্নে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ এ অঞ্চলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজ আমি এ অঞ্চলের পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে চাই। আমাদের মূল্যবোধকে এগিয়ে নিতে এবং নিরাপত্তাকে আরো জোরদার করতে আমাদের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে কথা বলতে চাই।
দুটি অনেক ক্ষতি ও ত্যাগের যুদ্ধ শুরুর পর দশক পার করে আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অনেকটা বদলে দিতে অনেক কাজ করেছি। ইরাকে বছরের পর বছর যুদ্ধের পর আমরা সেখান থেকে এক লাখ আমেরিকান সেনা ফিরিয়ে এনেছি এবং সেখানে কমব্যাট মিশনের ইতি টেনেছি। আফগানিস্তানে আমরা তালেবানের শক্তি ভেঙে দিয়েছি। আগামী জুলাই মাসে আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে সেখান থেকে ঘরে ফিরিয়ে আনব এবং পর্যায়ক্রমে কর্তৃত্ব আফগানিস্তানের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। বছরের পর বছর আল-কায়েদা ও আল-কায়েদার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার মাধ্যমে প্রচণ্ড ঝাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছি। বিন লাদেন কোনো শহীদ নন। তিনি ছিলেন একজন গণহত্যাকারী, যিনি প্রতিহিংসা ছড়িয়ে দিয়ে মুসলমানদের উসকানি দিয়েছেন পশ্চিমের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্য। নারী, পুরুষ ও শিশুদের হত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন পরিবর্তনের জন্য। সহিংস চরমপন্থার মধ্য দিয়ে তিনি গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর মূল এজেন্ডা ছিল তিনি কী সৃষ্টি করতে পারেন তা নয়, বরং তিনি কী ধ্বংস করতে পারেন সেটাই।
বিন লাদেন এবং তাঁর জিঘাংসু দৃষ্টিভঙ্গি কিছু সমর্থক পেয়েছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর আগেই আল-কায়েদা গুরুত্ব হারাতে শুরু করেছিল। কারণ বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে নিরীহ জনগণকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাদের উন্নত জীবনের দাবি পূরণ হবে না। এ সময় আমরা দেখেছি, বেশির ভাগ মানুষের কাছে বিন লাদেন এবং আল-কায়েদার আবেদন শেষ হয়ে গেছে এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার জনগণ তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। আত্মপ্রত্যয়ের এ কাহিনী শুরু হয় ছয় মাস আগে তিউনিসিয়ায়। ১৭ ডিসেম্বর রাস্তায় বিক্রেতা মোহাম্মদ বোয়াজিজি নামের এক তরুণের ঠেলাগাড়ি পুলিশ জব্দ করে এবং সে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটাই একমাত্র ঘটনা নয়। এমন অপমানজনক ঘটনা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে প্রতিদিনই ঘটছে। নির্দয় ও নৈরাজ্যকর সরকারগুলো তাদের জনগণের মর্যাদা অস্বীকার করছে। শুধু এবার কিছু একটা অন্য রকম ঘটল। স্থানীয় কর্মকর্তারা তার অভিযোগ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে কখনোই রাজনীতি না করা ছেলেটি প্রাদেশিক সরকারের দপ্তরে যায় এবং নিজের গায়ে জ্বালানি ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ইতিহাসের অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, সাধারণ নাগরিকদের কোনো প্রতিবাদ বিশাল পরিবর্তনের ভাষায় রূপ নিয়েছে। কারণ তারা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার কথাই বলেছে, যা বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠেছে। আমেরিকার বোস্টনে সেইসব প্রতিবাদকারীর কথা বিবেচনা করুন, যাঁরা রাজাকে খাজনা দিতে অস্বীকার করেছিলেন। অথবা রোজা পার্কের কথা ভাবুন, যিনি মর্যাদার সঙ্গে অনড় বসে ছিলেন তাঁর আসনে। ফলে এবার তিউনিসিয়ায় রাস্তার বিক্রেতার প্রতিবাদ সারা দেশের হতাশার প্রতিচ্ছবি হয়ে ধরা দিয়েছে। শত শত মানুষ প্রতিবাদ করে রাস্তায় নেমে আসে, তারপর হাজার হাজার। লাঠির সামনে, তারপর বুলেটের সামনে তারা ঘরে ফিরে যেতে অস্বীকার করল। দিনের পর দিন, সপ্তাহর পর সপ্তাহ_যতক্ষণ পর্যন্ত দুই দশকের অধিক সময় ক্ষমতায় থাকা একনায়ক ক্ষমতা না ছাড়লেন। এই আন্দোলনের পরের ধাপগুলোয় আর অবাক হওয়ার কিছু নেই। উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের জাতিগুলো স্বাধীনতা পেয়েছে অনেক দিন আগে, কিন্তু অনেক স্থানেই সেই স্বাধীনতা জনগণের জন্য আসেনি। অনেক দেশেই ক্ষমতা পুঞ্জীভূত রয়েছে অতি অল্প কিছু মানুষের হাতে। অনেক দেশে ওই রাস্তার বিক্রেতার মতো মানুষের কোনো পরিবর্তন আসেনি, তাদের অভিযোগের কোনো সুবিচার হয়নি। স্বাধীনভাবে গণমাধ্যম তাদের কথা বলতে পারেনি, কোনো প্রতিশ্রুতিশীল রাজনৈতিক দল তার কথার প্রতিনিধিত্ব করেনি; এমন কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা নেই_যেখানে সে নিজের পছন্দের নেতা বেছে নিতে পারে।
এই আত্মপ্রত্যয়ের অভাব, যেখানে নিজের ইচ্ছামতো জীবন তৈরি করার সুযোগ নেই, তা এ অঞ্চলের অর্থনীতিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। হ্যাঁ, অঞ্চলটির অনেক জাতি তেল ও গ্যাসসম্পদের সৌভাগ্যে ভাগ্যবান, যা তাদের উন্নতির পকেট তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনভিত্তিক বৈশ্বিক অর্থনীতির উন্নয়ন-কৌশল তাদের ভূমিতে গড়ে ওঠেনি। জনগণও সম্ভাবনা জাগাতে পারছে না, কারণ সেখানে ঘুষ না দিয়ে ব্যবসা শুরু করা যায় না। এ চ্যালেঞ্জের মুখে এ অঞ্চলের অনেক নেতা জনগণের দুঃখের কারণকে ভিন্ন দিকে আঙুল তুলে দেখাতে চেষ্টা করেন। উপনিবেশবাদের অবসানের অর্ধশত বছর পরও সব দুঃখের জন্য পশ্চিমাদের দায়ী করা হয়। ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত একমাত্র গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক ভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতি, গোষ্ঠী এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু গত ছয় মাসের ঘটনাবলি থেকে আমরা দেখেছি যে দমন-পীড়ন, দ্বিধাবিভক্ত করা এখন আর কোনো কাজে আসবে না। স্যাটেলাইট টেলিভিশন এবং ইন্টারনেট সারা পৃথিবীতে মানুষের জানালা খুলে দিয়েছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিলের মতো দেশগুলোতে বিস্ময়কর অগ্রগতির সুযোগ এনে দিয়েছে। সেলফোন ও সোশ্যাল নেটওয়ার্ক তরুণ সমাজকে যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। ফলে নতুন একটি প্রজন্ম উঠে এসেছে। তাদের কণ্ঠ আমাদের বলে দিচ্ছে যে পরিবর্তনকে অস্বীকার করা যাবে না।
কায়রোতে আমরা এক তরুণ মায়ের কণ্ঠে শুনেছি : মনে হচ্ছে যেন আমি শেষ পর্যন্ত প্রথমবারের মতো মুক্ত বাতাস থেকে নিশ্বাস নিতে পারছি। আমরা সানায় ছাত্রদের চিৎকার করে বলতে শুনেছি, 'অন্ধকার রাতের অবশ্যই অবসান হবে।' বেনগাজিতে আমরা প্রকৌশলীকে বলতে শুনেছি, 'আমাদের শব্দগুলো এখন মুক্ত। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের নয়।' দামেস্কে এক তরুণকে বলতে শুনি_প্রথম চিৎকারেই, প্রথম প্রতিবাদেই আপনি মর্যাদা অনুভব করবেন।'
মানুষের মর্যাদার এ চিৎকার গোটা অঞ্চলেই শোনা যাচ্ছে। অহিংস আন্দোলনের মূলমন্ত্র দ্বারা এ অঞ্চলে অনেক বেশি পরিবর্তন এসেছে, যা দশকের পর দশক ধরে সন্ত্রাসের দ্বারা অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
অবশ্যই এ বিশাল পরিবর্তন সহজে আসেনি। আমাদের এই সময়ে যখন ২৪ ঘণ্টা আমরা তথ্য ও যোগাযোগের মধ্যে আছি। জনগণ আশা করছে, এ অঞ্চলের পরিবর্তনের বিষয়টি হয়তো সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ হতে বছরের পর বছর সময় লাগবে। এর মধ্যে ভালো দিন আসবে, মন্দ দিনও আসবে। কোথাও কোথাও পরিবর্তন আসবে দ্রুত, কোথাও বা ক্রমান্বয়ে।
আজ আমাদের সামনে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, এই পরিবর্তনের জোয়ারে আমেরিকার ভূমিকা কী হবে?
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বারাক ওবামার ভাষণের প্রথম অংশ। বাকি অংশ আগামীকাল প্রকাশ করা হবে। ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করছেন মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.