শুরু: ১২ এপ্রিল ২০১২, গ্যালারি: জলরঙ-শিল্পের মহাযজ্ঞ by সিলভিয়া নাজনীন

সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সময় শিল্প এবং শিল্পীর প্রয়োজন হয় যথাসম্ভব নির্জনতা, আর প্রকাশিত হওয়ার সময় জনারণ্যই শিল্পের আরাধ্য। একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতিকে সার্বজনীন করে তোলার ক্ষমতাই একটা দেশ, জাতি কিংবা সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল হিসেবে শিল্পকে চিহ্নিত করে।


ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রয়েছে এমন অজস্র নিদর্শন। সমসাময়িক কালে শিল্পের মান-মাত্রা-মূল্য যা-ই হোক না কেন, কোনো কিছু যদি শিল্প পদবাচ্য হয়, ভবিষ্যৎ নির্মাণে এবং ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণে তার ভূমিকা থাকবেই। শিল্পের গতিবিধিকে তাই পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখতে হয়। বাংলাদেশের শিল্পকে বিস্তৃত পরিসরে দেখার এবং উপভোগ করার এক উপলক্ষ তৈরি হচ্ছে এই এপ্রিলে। এ দেশের শিল্পভুবনে এপ্রিলের ১২ তারিখ থেকে শুরু হবে বিবিধ শিল্পের বৈচিত্র্যময় মহাযজ্ঞ। প্রথমবারের মতো বৃহৎ পরিসরে চারুশিল্পের প্রদর্শনী ‘ঢাকা আর্ট সামিট’ আয়োজন করতে যাচ্ছে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের জন্ম মাত্র এক বছর, কিন্তু তাদের স্বপ্নের দৈর্ঘ্য দিগন্ত রেখার মতো বিস্তৃত। সেই স্বপ্নের প্রথম বড় পদক্ষেপ ঢাকায় শিল্পের শীর্ষ সম্মেলন।
‘সারা পৃথিবীতে আর্ট ফেয়ার হয়; শিল্পের ভুবনে এটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশে বিভিন্ন প্রদর্শনী হয়, তবে আমরা চাইছি দেশের শিল্পীদের শিল্পকর্ম একই প্ল্যাটফর্মে প্রদর্শন করতে’ এভাবেই শুরু করলেন সামদানী ফাউন্ডেশনের পরিচালক নাদিয়া সামদানী। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর চিত্রশালায় এই আয়োজন, তবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর তাদের নিজস্ব সংগ্রহ থেকে মাস্টার পেইন্টারদের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে। যেখানে শিল্পী, কিউরেটর, সংগ্রাহক, থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ বাংলাদেশের শিল্পের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাবে। এ দেশের প্রায় ৯০০ শিল্পী এই আর্ট সামিটে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, তবে স্বল্প পরিসরের কারণে মাত্র ২৪৯ জন শিল্পীর শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। তা ছাড়া এই একই সময়ে ঢাকার আরও ১৭টি গ্যালারি এই আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে।
ক্যানভাস চিত্রকর্মের পাশাপাশি ভিডিও আর্ট, পারফরম্যান্স, ইনস্টলেশন, ভাস্কর্য, ফটোগ্রাফি—এমন সবকিছু প্রদর্শিত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় যা কিছু হচ্ছে মূলত তার সমন্বয় দেখা যাবে এই আর্ট সামিটে।
ঢাকা আর্ট সামিটের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিল্পকলাকে একটি আন্তর্জাতিক শিল্পসম্মত রূপরেখায় বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করাই এর লক্ষ্য। ঢাকা শহরের বিভিন্ন ভেন্যুতে সামিট উদ্যাপন উপলক্ষে থাকছে নানা আয়োজন। এ ছাড়া রয়েছে আন্তর্জাতিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিশেষ প্রেজেন্টেশন, মিট দ্য প্রেস ও কিউরেটরিয়াল শো। এই সামিটে একটি স্পিকার ফোরাম করা হচ্ছে। দেশের বাইরে থেকে অনেক অতিথি আসছেন। তাঁরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে ঢাকায় আসছে একটি আন্তর্জাতিক জুরি কমিটি। এই জুরিরা হলেন ইংল্যান্ডের টেট মডার্ন মিউজিয়ামের কিউরেটর কাইলা ম্যাকডোনাল্ড, ফ্রান্সের ইকোল দে বুকস আর্টস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক দীপক আনান্থ, আর্ট এশিয়া প্যাসিফিক ম্যাগাজিন-এর সম্পাদক ও প্রকাশক ইলেইন ডবি­উএনজি, প্রখ্যাত ভারতীয় শিল্পী রবীন্দ্র রেড্ডি এবং প্যারিসপ্রবাসী বাংলাদেশি শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ (সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান)।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিল্পবোদ্ধা, শিল্পানুরাগী, শিল্পসংগ্রাহক ও সমালোচকসহ নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের মিলনমেলায় পরিণত হবে ঢাকা আর্ট সামিট। ইন্ডিয়া আর্ট ফেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক নেহা কিরপাল আগামী ১২ এপ্রিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া বিশ্বের বৃহৎ আর্ট অকশন হাউস ক্রিস্টিজের বিশেষ উপস্থাপনা এই আয়োজনের বিশেষ চমক। টেট মডার্ন মিউজিয়ামের কিউরেটর কাইলা ম্যাকডোনাল্ডের বিশেষ উপস্থাপনাও থাকছে। ছয়টি সেশনে আলোচনা হবে শিল্পানুরাগী, শিল্পবোদ্ধা, শিল্পসংগ্রাহকদের নিয়ে।
সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন ঢাকা আর্ট সামিটে দুটি বিশেষ পুরস্কার দিচ্ছে। একটি সামদানী আর্টিস্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, অন্যটি সামদানী ইয়াং আর্ট ট্যালেন্ট অ্যাওয়ার্ড; সামদানী প্রায় ৪০০ জন প্রতিযোগী থেকে ২৯ জনকে বাছাই করেছে, চূড়ান্ত নির্বাচন করবে বিদেশ থেকে যে জুরি বোর্ড আসবে তারা। প্রতিষ্ঠাতা-ট্রাস্টি রাজীব সামদানী বলেন, ‘সামিট করার মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে প্রচুর প্রতিশ্রুতিশীল-প্রতিভাবান শিল্পী রয়েছে। বিদেশে মূলত গ্যালারি শিল্পীদের রিপ্রেজেন্ট করে। তারা সিলেক্টেড আর্টিস্টকে বিভিন্ন দেশের আর্ট ফেয়ারে পাঠায়। কিন্তু এ দেশে তা হয় না। এখন যদি বাংলাদেশের আর্ট এবং আর্টিস্টকে লাইমলাইটে আনতে হয়, তাহলে বিভিন্ন ইভেন্ট প্রেজেন্ট করতে হবে; আমরা যে আয়োজনটি করছি সেটা সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায় পাবলিক ফেয়ার। প্রধান ভেন্যু শিল্পকলা একাডেমী এবং জাতীয় জাদুঘর। একই সঙ্গে প্রাইভেট গ্যালারি, যেমন-ঢাকা আর্ট সেন্টার, বেঙ্গল ফাইন আর্টস গ্যালারি লাউঞ্জ, সাজু, গ্যালারি কসমস, চিত্রক প্রভৃতি। এই সবার সহযোগিতা আমাদের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে। তাই আমরা সারা পৃথিবীকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি বাংলাদেশের শিল্পভুবন দেখার।’ বাংলাদেশের চিত্রকলা বিশ্বের যেকোনো দেশের চিত্রকলার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করেছে; এই আর্ট সামিটে পৃথিবীর সামনে নিজেদের তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা করা যায়।
নাদিয়া সামদানী বলেন, ‘আমরা ভীষণ আচ্ছন্ন শিল্পের প্রতি। এটা আমাদের আগ্রহের জায়গা। সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। আমরা বাংলাদেশের শিল্পকলাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত শিল্পধারা হিসেবে দেখতে চাই। বিভিন্ন দেশে আমাদের বন্ধুবান্ধব রয়েছে, তারা আগ্রহ ভরে জানতে চায়, দেখতে চায় বাংলাদেশের আর্ট সম্পর্কে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের আর্টকে বিশ্বে প্রমোট করা। এই ভাবনা থেকেই সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের জন্ম।’
গত বছর ভেনিস বিয়েনালের সময় কনটেমপরারি আর্টের ওপর ‘সামদানী আর্ট বুক’ প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর ভেনিসের ওপেন ফোরটিন্থ এক্সিবিশনে রনি আহমেদকে উপস্থাপন করে সামদানী ফাউন্ডেশন। তাদের আমন্ত্রণে গত বছরের শেষ দিকে টেট মডার্ন গ্যালারি বাংলাদেশে আসে স্বল্প সময়ের জন্য। সে সময় ঢাকা আর্ট সেন্টারে একটি এক্সিবিশনের আয়োজন করা হয়েছিল কিছু সিলেক্টড আর্টিস্টের শিল্পকর্ম দিয়ে। ‘এমনকি আমাদের দেশে যেসব সংগ্রাহক আছে, তারাও ঠিকমতো জানে না, আমাদের শিল্পীদের সম্পর্কে। এই আর্ট সামিটে আমরা চেষ্টা করছি দেশে নবীন-প্রবীণ- খ্যাতনামা-সম্ভাবনাময় শিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে একটি বৃহৎ প্রদর্শনীর আয়োজন করতে।’ জানান নাদিয়া।
১২-১৩ এপ্রিল ভিআইপিদের জন্য থাকবে বিশেষ আয়োজন। বাকি তিন দিন সাধারণ শিল্পপ্রেমী মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
ভবিষ্যতে কোনো গ্যালারি করার পরিকল্পনা নেই সামদানী ফাউন্ডেশনের। বাংলাদেশের শিল্পকলাকে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপকভাবে পরিচিত করাই ফাউন্ডেশনের একমাত্র লক্ষ্য। নিজস্ব অর্থায়নেই এই ফাউন্ডেশন চলছে। শিল্পের বাণিজ্যিক ব্যবহারের কোনো লক্ষ্য নেই তাদের।
২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে বৃহৎ পরিসরে আর্ট ফেয়ার করবে সামদানী ফাউন্ডেশন, একই সময়ে ভারত ও শ্রীলঙ্কাতেও আয়োজন করা হবে একই ধরনের শিল্প সম্মেলন। সারা বিশ্বের অনেক শিল্পপ্রেমী আসবে এবং তারা এই সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিল্প ঐতিহ্য উপভোগের সুযোগ পাবে।

No comments

Powered by Blogger.