আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৬৯)-নির্বাসনে কলকাতায় by আলী যাকের

ত্রিপুরার ধর্মতলা থেকে আসামের লামডিং- এই পথটুকুর ঐতিহাসিক নাম পাহাড় লাইন, আগেই বলেছি। অবশ্যই ব্রিটিশদের দেওয়া নাম। এই রেলপথও ওদেরই তৈরি। আজও মনে আছে, আমার কোনো এক ভারতীয় রেল কর্মচারী বলেছিল আমাকে। ভারতের আর কোনো রেলপথ নেই, যা এতগুলো টানেলের মধ্য দিয়ে যায়।


কিছুক্ষণ পর পরই ট্রেন ঢুকে পড়ছিল গাঢ় অন্ধকার টানেলের ভেতরে। বেরিয়ে এলেই দেখা যাচ্ছিল, পাহাড়ের গা বেয়ে ধাপে ধাপে নেমে গেছে রেললাইন। যে লাইন দিয়ে একটু আগেই এই ট্রেন এসেছে, সেই লাইন দেখা যাচ্ছে এই ধাপ থেকে ওপরে। আবার তার নিচেই আছে যে লাইন, তা দিয়ে গড়িয়ে যাবে এই ট্রেন মিনিট কয় বাদে। এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য এর আগে কদাচিৎ প্রত্যক্ষ করেছি আমি। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, দেশ যদি কোনো দিন স্বাধীন হয় তখন আরেকবার বেড়াতে আসব এই পথে। দেখা যাচ্ছিল সবই। আমি যেন দিব্য দৃষ্টিতেই দেখতে পাচ্ছিলাম, যদি কোনো কারণে বাঙালি হিসেবে টিকে থাকার এই যুদ্ধে বাঙালি পরাজিত হয়, তাহলে আমার অবস্থাটা কী হবে?
পাহাড় লাইন শেষে আসামের লামডিং জংশনে ট্রেন বদল। তারপর নিউ বোনগাইগাঁ স্টেশন হয়ে ফারাক্কা বাঁধের ওপর দিয়ে কলকাতার পথে যাত্রা। ফারাক্কায় ফেরি পার হওয়ার সময় দেখা যাচ্ছিল ফারাক্কা বাঁধ। আমার মনে হলো, এই বাঁধ তো পূর্ব বাংলায় অনেক সমস্যা সৃষ্টি করবে? এও মনে হলো যে পাকিস্তান আমলে সিন্ধু অববাহিকায় লবণাক্ততার সমস্যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে কত সহজেই তো সমাধান করেছিলেন আইয়ুব খান ভারতের সঙ্গে? তখন একবারও প্রশ্ন ওঠেনি, অমুসলিম ভারতের সঙ্গে কিভাবে আপস করা যায়? অথচ পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য ফারাক্কা সমস্যার কোনো সমাধানের চেষ্টাই করেনি পাকিস্তান সরকার। কেবল পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকেই ভারতবিদ্বেষী আফিম সেবন করিয়ে একটা কৃত্রিম রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করাই ছিল তাহলে উদ্দেশ্য? যাতে যখনই পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষ নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার সম্বন্ধে প্রশ্ন করবে তখনই যেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা বলতে পারে, 'উঁহু, কোনো কথা নয়, ওই ভারত আসছে আক্রমণ করতে। পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন।' মূল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য কত জঘন্য সব চক্রান্তের সৃষ্টি!
সন্ধ্যা ৭টায় লাল রঙের প্যাসেঞ্জার ট্রেনটা এসে থামল শিয়ালদহ স্টেশনে। সেই সুদূর ত্রিপুরার ধর্মনগর থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরের দীর্ঘ পথপরিক্রমা অবশেষে শেষ হলো আমাদের। কলকাতা শহরে ঢোকার প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূর থেকেই ট্রেনের কামরাটি খালি হতে শুরু করেছিল। কলকাতায় পৌঁছতে পৌঁছতে এই তৃতীয় শ্রেণীর কামরাটিতে ছিল জনা দশ-বারো লোক।
আমি আবিষ্কার করি, শিয়ালদহ সেই আগের মতোই আছে। সেই ছেলেবেলায় মায়ের হাত ধরে ঢাকা মেল থেকে নেমে যেমন মনে হতো। কী বিশাল স্টেশন! কত হাজার হাজার মানুষ! কত মানুষ শুয়ে আছে প্লাটফর্মের ওপর। ওখানেই ওদের সংসার। আহার, আচমন, নিদ্রা, সন্তান ধারণ, সন্তান প্রসব। প্রথমবার বোধোদয়ের পর, শিয়ালদহের প্লাটফর্মে ওই মানুষগুলোকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। নোংরা মেঝের ওপরও এত মানুষ থাকে? তখন আমরা থাকতাম পূর্ব পাকিস্তানের কুষ্টিয়ায়। ছোট্ট শহর। ততধিক ছোট্ট একটি রেলস্টেশন। কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশন। ট্রেন এসে থামলে স্টেশনে কিছু প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ট্রেন চলে গেলে আবার সব সুনসান। কাজেই শিয়ালদহ অবাক করেছিল আমাকে। জিজ্ঞেস করেছিলাম মাকে, এরা কারা? মা খুব সংক্ষেপে জবাব দিয়েছিলেন, 'ওরা রিফিউজি'। শব্দটা বুঝিনি আমি। বোঝার কথাও নয়। ছয়-সাত বছর বয়সে রিফিউজি শব্দটির অর্থ জানা দুষ্কর, রিফিউজি না হলে। তখন আমার মনে হয়েছিল, রিফিউজি কোনো বিশেষ জাতের মানুষ। পাঞ্জাবি যেমন কিংবা বিহারি অথবা বাঙালি।
আজ, এই ক্ষণে, এই লোকারণ্য শিয়ালদহ স্টেশনে, হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ে গেল আমার। মা মারা গেছেন প্রায় আট বছর হয়ে গেল। এপ্রিল মাসের তের তারিখে পূর্ব পাকিস্তানের কসবা স্টেশনের কাছ দিয়ে বর্ডার পার হওয়ার সময় রিফিউজি শব্দটা হঠাৎ করেই মাথায় ধাক্কা মেরেছিল আমার। চোখ ভিজে এসেছিল। চোখ ভেসে গিয়েছিল। কান্নাভেজা কণ্ঠে অস্ফুটে প্রয়াত মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলাম, 'এখন জানি মা, রিফিউজি কাকে বলে?' এই রিফিউজি কথাটি তাড়া করে ফিরেছে আমাকে আগরতলায়ও। একটা দশ ফুট বাই বারো ফুট ঘরের মেঝেয় আট-দশজন লোক গাদাগাদি শুয়ে রাতভর জেগে থাকা। সারা রাত কিছুক্ষণ পর পরই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায় একেকজনের। কী হবে? যুদ্ধ করব কী? করতে পারব? বাংলাদেশ স্বাধীন হবে? দেশে ফিরব? যাদের ছেড়ে এসেছি দেশে তারা বেঁচে থাকবে কী? তাদের সঙ্গে দেখা হবে আবার? আবার আমার প্রিয় ঢাকা শহরে নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াতে পারব? বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারব? মরণচাঁদের দোকানে বসে দই খেতে পারব? মগবাজারের মোড়ে ক্যাফে তাজ-এ বসে আড্ডা মারতে পারব?
শিয়ালদহ স্টেশন লোকে লোকারণ্য। এবারও আমি দেখলাম, হাজার হাজার মানুষ বিছানা পেতেছে প্লাটফর্মে। তবে এরা আমার বাল্যকালে দেখা রিফিউজি নয়। এরা আজকের রিফিউজি। গণতান্ত্রিক উপায়ে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়ার জন্য দেশ থেকে বিতাড়িত। ছোটবেলায় দেখা রিফিউজিদের যে ভিড় প্রত্যক্ষ করেছিলাম, তাদের সবাই ছিল ছিন্নমূল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। আজ, এই জাতিসত্তা, ভাষা এবং সংস্কৃতি নিধনের শিকার বাঙালি। বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। হাজার হাজার মানুষকে শিয়ালদহ যেন উদর থেকে উগড়ে দিচ্ছে রাজপথে। আবার হাজার মানুষকে চোখের পলকে উদরস্থ করছে। স্টেশনের একাধিক প্লাটফর্মে নিরন্তর ভিড়ছে ট্রেন। আবার ছেড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন গন্তব্যে।
ভিড়ের ধাক্কায় স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। মুক্ত আকাশ মাথার ওপর। কলকাতার আকাশ। ছোটবেলায় পূর্ব বাংলার কোনো মফস্বল শহর থেকে এসে যে শহরকে মনে হতো স্বপ্নের নগর। আজকে অবশ্য আমার মানসিক অবস্থা ভিন্ন। আজ কলকাতার বার্ষিক ছুটিতে বেড়াতে আসা নয়। আজ আমি নির্বাসনে এসেছি এই শহরে।
চলবে...)

No comments

Powered by Blogger.