খোলা চোখে-এক দেশ দুই ভাষা by হাসান ফেরদৌস

বছর দুয়েক আগে এই কলামে আমি একটি সবিনয় প্রস্তাব রেখেছিলাম। বাংলাদেশে যেভাবে ইংরেজি ক্রমশ আমাদের শাসকশ্রেণীর ভাষা হয়ে উঠছে, তাতে শুধু বাংলায় লেখাপড়া করে পাস করেছে এমন ছাত্ররা সামাজিকভাবে যেমন, তেমনি পেশাদারি জীবনেও পিছিয়ে পড়ছে। চাই বা না চাই,


ইংরেজি ভাষার ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ওপরতলা-নিচতলার মধ্যে এক ধরনের অলঙ্ঘনীয় দেয়াল তুলে দিচ্ছে। আমার প্রস্তাব ছিল, এই দেয়াল ভাঙার লক্ষ্যে একদম প্রথম শ্রেণী থেকে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষার প্রচলন। তাতে ইংরেজি বোলচালে অভ্যস্ত সাহেব-বাবুদের পুরোপুরি ঠেকানো না গেলেও বাকি সবার সঙ্গে তাদের দূরত্ব কিছুটা হলেও কমবে।
সে প্রস্তাব শুনে অনেক পণ্ডিতজন আমাকে কশে গাল দিয়েছিলেন। ভাগ্যিস হাতের কাছে ছিলাম না, তাহলে হয়তো দুই ঘা বসিয়েও দিতেন। এসব পণ্ডিতজনের যুক্তি, মাতৃভাষার চেয়ে উত্তম কোনো শিক্ষার মাধ্যমে নেই। অতএব বাংলাকে মুখ্য ভাষার ভূমিকা দিতেই হবে। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিশুদের ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে শিশুদের ওপর যে চাপ পড়বে, তা সহ্য করার ক্ষমতাও তাদের নেই। তা ছাড়া ভালোভাবে বাংলা শেখানোর ব্যবস্থাই আমরা পাকাপোক্ত করতে পারিনি, তার ওপর আবার ইংরেজি! এ যেন গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল!
শিশুরা যে একই সঙ্গে একাধিক ভাষা শিখতে পারে, তাদের মস্তিষ্কের সে ধারণক্ষমতা আছে, এটা মোটামুটি প্রমাণিত সত্য। গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় যুদ্ধজিৎ চক্রবর্তী এ ব্যাপারে গোটা কয়েক উদাহরণ দিয়েছেন। তাঁর সে লেখা পড়ে উৎসাহিত হয়েই বিষয়টি নতুন করে উত্থাপন করতে চাই। ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন এমন বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, শিশুদের যদি একই সঙ্গে দুটো ভাষা শিখতে দেওয়া হয়, তাহলে তাদের মস্তিষ্কের ওপর চাপ পড়বে, তাতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু এই চাপ কোনো ক্ষতি না করে বরং তাদের বিদ্যাশিক্ষায় সুবিধাই করবে। শুধু বিদ্যাশিক্ষায় নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও তার সুফল পড়বে। ভাষা ব্যবহারের জন্য দরকার মস্তিষ্কের জ্ঞানদান ক্রিয়া বা কগনিটিভ সিস্টেমের। যারা দুটো ভাষায় সমান পারঙ্গম, ভাষা ব্যবহারের সময় তাদের মস্তিষ্কে একই সঙ্গে দুই ভাষার কগনিটিভ সিস্টেম সক্রিয় থাকে। যখন শুধু একটি ভাষা ব্যবহূত হয়, তখনো দ্বিতীয় ভাষার কগনিটিভ সিস্টেমটি সমান সজাগ থাকে। যদি কখনো প্রয়োজন পড়ে, তাহলে দ্বিভাষিকের পক্ষে সহজেই এক সিস্টেম থেকে অন্য সিস্টেমে প্রবেশ করা কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে না।
যুদ্ধজিৎ ইতালির ত্রিয়েস্ত থেকে একটি উদাহরণ দিয়েছেন। ২০০৯ সালে সেখানকার বিখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিস একদম শিশুকাল থেকে দুই ভাষায় অভ্যস্ত শিশুদের একভাষিক শিশুদের সঙ্গে তুলনা করে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। প্রথমে শিশুদের এক বিশেষ আওয়াজের মাধ্যমে ‘কিউ’ দিয়ে টেলিভিশনের পর্দার একদিকে পুতুলের ছবি দেখানো হয়। সে আওয়াজ হলে শিশুরা পুতুলের দিকে তাকাবে। উভয় গ্রুপের শিশুরা এই কাজে সহজেই অভ্যস্ত হলো। এরপর শিশুদের পুতুলের ছবি দেখানো হলো পর্দার উল্টো দিকে। পরীক্ষার এই পর্যায়ে দ্বিভাষিক শিশুরা সহজেই নতুন পর্দার দিকে তাকিয়ে দেখার প্রাক-প্রস্তুতি অর্জন করল, কিন্তু একভাষিক শিশুরা সেই কগনিটিভ দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হলো না। যুদ্ধজিৎ দুজন ফরাসি মনস্তাত্ত্বিকের করা আরেকটি নিরীক্ষার উদাহরণ দিয়েছেন। একভাষিক ও দ্বিভাষিক শিশুদের তাঁরা প্রথমে বিভিন্ন আকারের জিনিস লাল বা নীল রং মিলিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বাক্সে রাখতে বললেন। উভয় গ্রুপের ছেলেমেয়েরাই কাজটা সহজে করে ফেলে। এরপর তাদের বলা হলো রং নয়, আকার মিলিয়ে জিনিসগুলো ভাগ করে রাখতে হবে। আর যে বাক্সে এসব রাখতে হবে, তাতে লাল ও নীল দুই ধরনের রঙের চিহ্নই থাকবে। দেখা গেল দ্বিভাষিক শিশুরা কাজটা যত সহজে করতে পারল, একভাষিকেরা ততটা নয়।
এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে বিজ্ঞানীরা যে উপসংহারে পৌঁছেছেন তা হলো, আমাদের মস্তিষ্কের যে নির্বাহী কার্যক্ষমতা রয়েছে, দ্বিভাষিক অভিজ্ঞতা তা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এই নির্বাহী কার্যক্ষমতা বা একজিকিউটিভ ফ্যাংশন আমাদের মনোযোগের ভিত নির্মাণ করে, ছোট-বড় সব ব্যাপারে আগাম পরিকল্পনায় সাহায্য করে, মানসিক বুদ্ধির প্রয়োজন পড়ে এমন সব কাজে যথাযথ ‘সিগন্যাল’ পাঠায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, একভাষিকদের তুলনায় দ্বিভাষিকদের মস্তিষ্কের নির্বাহী ক্ষমতা বেশি। এর একটা কারণ, এই শ্রেণীর মানুষ তাদের পরিপার্শ্ব সম্বন্ধে অনেক বেশি সচেতন। ব্যাপারটা অনেকটা গাড়ি চালানোর মতো। গাড়ি চালানোর সময় চালক সামনের দিকে তাকিয়ে থাকেন বটে, কিন্তু চোখ-কান সজাগ রাখেন ডান, বাম বা পেছন থেকে কোনো যান বা মানুষ এসে পড়ে কি না। ভাষার ব্যাপারটাও অনেকটা তা-ই। মস্তিষ্কের এই অতি সক্রিয়তা শিশুদের শুধু ভাষার ব্যাপারে নয়, প্রায় সব ব্যাপারেই অধিক চটপটে ও দক্ষ করে তোলে। মস্তিষ্কের এই সক্রিয়তা শুধু যে শৈশব বা যৌবনে আমাদের তীক্ষ ও অধিক চটপটে করে তা-ই নয়, পরিণত বয়সে ‘ডিমেনশিয়া’র মতো ক্ষয়কারক রোগের আগমন মন্থর করতেও সাহায্য করে।
এ তো গেল বিজ্ঞানের কথা। আমি যে কারণে দ্বিভাষিকতার ওপর জোর দিচ্ছি তা সম্পূর্ণ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক।
ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠিও সে। সেদিন খুব বেশি আগের নয়, যখন নিজেদের ‘আশরাফত্ব’ প্রমাণ করতে একদল লোক—তারাই সে সময় সমাজের হর্তাকর্তা ছিলেন—বাংলায় কথা না বলে উর্দুতে কথা বলতেন। উর্দুর বদলে এখন নতুন স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে ইংরেজি। তাৎপর্যার্থে এই দুইয়ের মধ্যে কোনো তফাত নেই। সমাজের ওপর ও নিচতলার মধ্যে যে একটা বিভাজনরেখা আছে, স্বাধীন বাংলাদেশে তা বোঝানোর মাধ্যম হয়েছে এই ইংরেজি। বাংলা ভাষা সর্বক্ষেত্রে চালু হোক, এই দাবি নিয়ে যে শিক্ষানীতি আমরা চালু করেছি, তাতে বাংলার গুরুত্ব বেড়েছে বটে, কিন্তু ইংরেজির গুরুত্ব মোটেই কমেনি। বরং বেড়েছে। এর একটা কারণ বিশ্বায়ন। কিন্তু অন্য কারণ, আমার বিবেচনায়, অনেকটা ইচ্ছাকৃত। যাঁরা আমাদের সমাজপতি অর্থাৎ গতকালের আশরাফকুল—তাঁরা এখনো ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ওপর-নিচের এই ফারাকটুকু যাতে না বদলায় সে জন্য তাঁরা ভেবেচিন্তে আমাদের দেশে দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছেন। সরকারি স্কুলে এবং কম দামি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার মাধ্যম এখনো বাংলা। কিন্তু ওপরতলার মানুষদের জন্য রয়েছে প্রাইভেট স্কুল, যেখানে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো যেখানে অভিন্ন জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম অনুসরণ করে থাকে, সেখানে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল অনুসরণ করা হয় কেমব্রিজ পরীক্ষা ব্যবস্থা ‘ও’ বা ‘এ’ লেভেল পদ্ধতি। যারা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে, তারা ধরেই নেয়, আজ হোক কাল হোক, দেশের বাইরে তারা যাবেই, হয় উচ্চশিক্ষার্থে অথবা চাকরির সন্ধানে। আর দুর্ভাগ্যক্রমে যদি দেশে পড়ে থাকতেই হয়, তাহলে চাকরি, ব্যবসা, তথ্যমাধ্যম—সবখানেই তাদের রাজত্ব হবে একচ্ছত্র। আজকের বাংলাদেশের এই ছবি আমাদের সবারই পরিচিত।
যারা ইংরেজি জানে, তারা যে অর্থনৈতিকভাবে অধিক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, সে কথায়ও কোনো ভুল নেই। শিল্পী কাপুর ও তনুকা চক্রবর্তী নামে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ইন সেন্ট লুইসের দুই গবেষক পশ্চিম বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর এক গবেষণা করেছেন। ওই রাজ্যে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৭ সালে সরকারি স্কুলে প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজি তুলে দেওয়া হয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতে অবশ্য সেই প্রথম শ্রেণী থেকে ইংরেজি শেখার যে চল ছিল, তার কোনো রদ-বদল হয়নি। গরিব-গুর্বোরা সরকারি স্কুলে যায়, কিন্তু কর্তাবাবুদের ছেলেমেয়েরা ঠিকই ওই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে যাওয়া অব্যাহত রাখল। ২০ বছর পর দেখা গেল, যারা রাজ্যের এবং রাজ্যের বাইরে বড় চাকরি-বাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, তারা সব ওই কর্তাবাবুদেরই পুত্র-কন্যা। কাপুর ও চক্রবর্তী তাদের গবেষণায় ২০০৪ সালের সরকারি উপাত্ত ব্যবহার করে দেখিয়েছেন, ইংরেজি জ্ঞানের ক্ষেত্রে যদি মাত্র ১ শতাংশ কমতি ঘটে, তাহলে শ্রমিক-কর্মচারীদের সাপ্তাহিক বেতন ১ দশমিক ৬ শতাংশ কম অর্জিত হয়। এভাবে শুধু ভাষার জন্য প্রায় ৬৮ শতাংশ বেতন বা আয় কমে আসে।
আমাদের দেশের অবস্থাও খুব ভিন্ন কিছু নয়। একই দেশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে যে দুই ব্যবস্থা আমরা চালু করেছি। আমার বিবেচনায় তা এক ধরনের বর্ণবাদী ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা চালু রাখার মানে আজ যারা ছড়ি ঘোরাচ্ছে, তারাই আজীবন ছড়ি ঘুরিয়ে যাবে। দেশটা যদি সত্যি সত্যি সব মানুষের বাসস্থান হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। সবার আগে যা দরকার তা হলো সব ক্ষেত্রে—শিক্ষা, কর্ম, ব্যবসা বা রাজনীতি—সবার জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা। এই ‘ইকুয়াল অপরচুনিটি’র অর্থ এই নয় যে সবাই রাতারাতি সর্ববিষয়ে সমানাধিকার অর্জন করবে। তা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি কাঙ্ক্ষিতও নয়। যারা অধিক পরিশ্রমী, অধিক মেধাবী, তারা অন্য সবার চেয়ে এগোবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে পরীক্ষায় যাওয়ার আগে যা দরকার তা হলো এমন খেলার মাঠের, যা সবার জন্য সমান রকম সমান্তরাল।
প্রতিটি শিশুকে একই সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা শেখার সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে সেই খেলার মাঠকে সমান্তরাল করার ব্যাপারে একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। আমি এ কথা বলছি না কেউ একজন বলে দিল, অথবা পার্লামেন্টে আইন পাস হলো আর অমনি সবার জন্য সর্ব অধিকার উন্মুক্ত হয়ে গেল। মোটেই না। এ জন্য একদিকে যেমন চাই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, তেমনি চাই মৌল কাঠামো নির্মাণ। চাই শিক্ষক, পাঠ্যপুস্তক, পরীক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ। কাজটা কঠিন, ব্যয়সাধ্য, দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
দীর্ঘ পাল্লার যাত্রা শেষ করতে হলে কোনো না কোনো সময় প্রথম কদম তো ফেলা চাই।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.