নজরুলের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ by জাহিদ হায়দার

মনে করা যাক, কাজী আমিনউল্লাহ ও জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান দুখু মিয়ার বয়স এখন ২৫ বছর। প্রায় আট বছর আগে ফিরেছেন সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসী লোভে বর্তমান বিশ্বে সৃষ্ট কোনো এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। কামানের কাঁধে হাত রেখে, চোখ সম্মুখের ভবিষ্যতে বিদ্ধ করে দৃপ্তপ্রত্যয়ী একটি ছবিও তুলেছেন (এই ছবি থেকে আমরা ভাবতে পারি, নজরুল


যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে হাতের নিচে যুদ্ধাস্ত্র রেখেছেন এই ভেবে, আর যুদ্ধ নয়)। লিখে ফেলেছেন বিশ্ব কবিতার মধ্যে বিবেচিত 'বিদ্রোহী' শিরোনামের একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। যে কবিতার মূল দর্শন পীড়িত মানুষের মুক্তি, সব ধরনের অশুভর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং মানুষই অজেয়।
কবিরা স্বপ্নব্যবসায়ী। বাস্তবতা খরচকারী। কবিরা আনপ্রেডিকটেবল। যদিও নিজ স্বাধীনতাকে কখনোই ছাড়তে তাঁরা রাজি নন। তাঁরা যে সুন্দর পৃথিবীর জন্য স্বপ্নব্যবসা করেন, তার কথা বলেন, সেই হাজার হাজার বছর আগে থেকে বলেই আসছেন; কিন্তু এখনো আসছে না সেই বাসযোগ্য পৃথিবী; তার পরও মানুষ কেন দুঃসময়ে, পচনপ্রবণ সময়ে একজন কবির কথা শুনতে চায়? কবিরা মানুষকে যত শ্রেয়-বোধসম্পন্ন-জীবনস্বপ্ন দেখান এবং মানুষকে ওই পথে যেতে প্রেরণা জোগান তা কবিরা ছাড়া অন্য কেউ পারেন না বলেই মানুষ অপেক্ষা করে কবির জন্য। সব কবিই বড় রাজনীতিবিদ, সব রাজনীতিবিদ কবি নন। ভালো রাজনীতিবিদ মানুষের কল্যাণ যেমন প্রত্যশা করেন, কবিরও আকাঙ্ক্ষা তাই। সে বিবেচনায় ওই বিশিষ্ট রাজনীতিবিদকেও কবি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। প্লেটোর (তাঁর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রে তিনি কোনো কবিকে রাখতে চাননি) অতি ভক্তরা অবশ্য এই বক্তব্যকে হাস্যকর মনে করতে পারেন।
প্রশ্ন আসতে পারে, নজরুলের বয়স এখন ২৫ হলে কবি হিসেবে তিনি এই আমাদের সৃষ্ট কালবেলাপীড়িত বাংলাদেশে কী করতেন? স্বাভাবিক উত্তর_কবিতা লিখতেন। পরের প্রশ্ন, কী রকম কবিতা লিখতেন? কি 'জবানবন্দী' লিখতেন? কাটাতেন কি অনশনে?
বাংলা কবিতার ইতিহাসে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনাকে, মানুষের ভণ্ডামিকে, বিশেষ করে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ধর্ম ব্যবসাকে সরাসরি কাব্যভাষায় তাঁর আগে এতটা সার্থকভাবে শব্দচিত্রিত করতে পারেননি কোনো কবি। 'বর্তমানের কবি আমি ভাই' বলে বর্তমানের ক্ষতকে শুধু চিহ্নিত করেই 'ফুলের জলসায় নীরব' থাকেননি, 'আনন্দময়ীর আগমনে' লিখে জেলেও গেছেন। আমাদের এই দেশ ৪০ বছর ধরে যত চড়াই পথ অতিক্রম করছে, সেই তুলনায় উতরাই অনেক কম। আমাদের জীবনযাপনের মধ্যে এক শ্রেণীর শাসক এক রক্তচুলি্ল দিবারাত্রি জ্বালিয়ে ঢোল বাজিয়ে প্রতি প্রহরে জনগণকে বলছে, চুলি্লতে পানি গরম কর, গোসল করব। এবং তারা গোসল করছে আর হাসছে। তাদের ভোগী দাঁত থেকে রক্ত পড়ছে, দেখতে পারছে না। শাসকদের জন্য জনগণের মুখই যে আসল আয়না, তা চেয়ারে বসার পর প্রায় সব শাসকই ভুলে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে চিরশায়িত (যদিও কবিদের শয়ন কখনো 'চির' হয় না, কেননা কবির রচনাবলি মানুষের মধ্যে কল্যাণবোধ জাগায়) নজরুলের সমাধি আমি যখনই দেখি, মাথায় প্রশ্ন আসে, এখন তাঁর সঙ্গে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'অপরাজেয় বাংলা'র ওই তিন মুক্তিযোদ্ধার পায়ের নিচে বসে আমার দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা নিয়ে আমি তাঁকে এক ডিব্বা পান আর কাপের পর কাপ চা দিয়ে বিনীত প্রশ্ন করি, কবি এই দেশ-কাল নিয়ে কিছু বলুন? নজরুল কী বলতেন? প্রশ্ন শুনে 'দে গরুর গা ধুইয়ে' বলে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রদের টেন্ডারবাজিতে নিয়োজিত দর কষাকষির দিকে এক অট্টহাসি দিতেন? নাকি তাঁর বিশ্বধরা চোখ দুটো ঈষৎ ছোটো করে তাকাতেন, যেন গভীর কিছু ভাবতেন, সম্মুখে আর একটু বিরতি দিয়ে কিছু কথা বলতেন।
তিনি কিছুক্ষণ কোনো কথা বলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের চলাচল আর বসে থাকার দিকে তাঁর চোখ নিবদ্ধ এবং তাকালেন আকাশের দিকে এবং পরক্ষণেই আমার দিকে।
আমি তাঁর কষ্টপীড়িত স্বর শুনি।
'দুইজন সামরিক শাসক এই দেশের ধর্মভীরু মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে বন্দুক পরিচালিত রাজনীতি করার জন্য সংবিধানে-রাজনীতিতে 'বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' বসিয়েছেন এবং তা প্রচার করার জন্য কিছু সুবিধাবাদী দালালও পেয়ে গেছেন। দুই সামরিক শাসক নিশ্চয়ই 'মদিনা সনদ' ও 'হুদাইবিয়ার সন্ধি' সম্পর্কে জানতেন। মদিনা সনদের কোথাও 'ইসলামী রাষ্ট্র' বা ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। নবীজি সেই সময়ের মদিনার সব ধর্ম বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে শান্তি ও সৌহার্দ বজায় রাখার জন্য এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের যে বিধান করেছিলেন, তা কেউ গ্রহণ করছে না। জান, হুদাইবিয়ার সন্ধিতে 'বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম' লিখে সন্ধিগুলো লেখা হলে কুরাইশরা 'বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম' বিষয়ে আপত্তি করাতে স্বয়ং নবীজি সন্ধিপত্র থেকে 'বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম' বাতিল করেছিলেন। আমার কথা তোমার বিশ্বাস না হলে আল্লামা শিবলী নোমানীর লেখা 'সিরাতুন নবী' দেখে নিতে পার। এ দেশে নবীর থেকে বড় ইসলামপ্রীতি দেখানো কু-কৌশলী লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে।'
কবি আরো বলেন, 'নারীনীতি নিয়ে মৌলভীরা মিছিল-মিটিং করছেন। আর নারী অধিকার নিয়ে যাঁরা অনেক দিন থেকে সোচ্চার তাঁরা শুধু সেমিনার করছেন, বিবৃতি দিচ্ছেন। মিছিল-মিটিং করছেন না কেন? এই দেশের মানুষ মিছিল থেকে রাজনীতি শেখে, বোঝে। সেমিনার দিয়ে কিছু সুশীল তাদের সুবিধামতো রাজনীতি বোঝে আর টকশো করে।'
নিজেকে আমার অপরাধী মনে হয়, নজরুলের জীবন-দর্শন ও লেখালেখির মৌলিক স্বর থেকে আমাদের রাজনীতিবিদরা কিছুই শেখেননি, আমরাও শিখিনি, অথবা শিখেও কেবল নিজের সুবিধার জন্য তা ব্যবহার করতে নারাজ। কবিকে শুধু 'জাতীয় কবি' বানিয়ে রেখেছি!
লেখক : কবি

No comments

Powered by Blogger.