পাহাড়ে 'লাদেন গ্রুপের' জমি কেনার ধুম-রহস্য খতিয়ে দেখছে প্রশাসন ও গোয়েন্দারা by তোফায়েল আহমদ

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অফিসে ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর সাড়ে তিন একর জমি বিক্রি-সংক্রান্ত একটি বায়নানামা দলিলের (নম্বর ১২৯৮) রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়। দলিলে গ্রহীতার স্থলে লেখা হয়েছে, 'সভাপতি, মোহাম্মদীয়া জামেয়া শরীফ, বনপুর, ২৮৪/ইয়াংছা মৌজা, লামা, বান্দরবান'।


আর দলিলের দাতা হচ্ছেন লামার ২৮৫ সাঙ্গু মৌজার বাসিন্দা মোহাম্মদ হামজার ছেলে আবদুল জলিল। সাড়ে তিন একর জমির মূল্য ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার টাকা। দলিলটির লেখক স্থানীয় বাসিন্দা নিরন কান্তি চৌধুরী। অনুসন্ধানে 'মোহাম্মদীয়া জামেয়া শরীফ'-এর নামে নিবন্ধিত বা অনিবন্ধিত জমির প্রকৃত পরিমাণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটির নামে গত তিন বছরে জমি কেনা হয়েছে পাঁচ হাজার একরেরও বেশি। তাও কেনা হয়েছে বান্দরবান জেলার লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার পাহাড়ি এলাকায়। ব্যাপারটা রহস্যময় বলে খোদ প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই মন্তব্য করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, এত বিপুল জমির কেনাবেচায় রয়েছে অস্বচ্ছতা। এ কারণে উচ্ছেদ হতে হয়েছে অনেক উপজাতি পরিবারকে। তা ছাড়া মোহাম্মদীয়া জামেয়া শরীফ নামে কোনো সংস্থার অস্তিত্বও এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এলাকায় 'লাদেন গ্রুপ' নামে একটি নাম ইদানীং বহুল আলোচিত।
পার্বত্য জেলাগুলোতে, বিশেষ করে বান্দরবানে সাম্প্রতিককালে নানা ব্যক্তি ও সংস্থার নামে জমি জবরদখলের ঘটনায় বঞ্চিত উপজাতিদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির বান্দরবান জেলার সমন্বয়ক আবুল কালাম। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, বান্দরবানের সর্বশেষ ভূমিগ্রাসী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে লাদেন গ্রুপ। এ বাহিনীটি স্থানীয় লোকজনের কাছে ইতিমধ্যে আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, লামার ইয়াংছা মৌজার বনপুর এলাকার পাশের রাজাপাড়ার (হেডম্যানপাড়া হিসেবে পরিচিত) ১৬/১৭টি মুরং অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাদের জমি দখলে নিয়েছে লাদেন গ্রুপ। পাহাড়ি জনপদে আতঙ্ক ছড়িয়ে একের পর এক জমি দখলে নিচ্ছে এ গ্রুপের লোকজন। তাদের নামের সঙ্গে লাদেনের নাম থাকায় লোকজন ভয়ে চুপচাপ থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
পাহাড়ি এলাকার এত বিপুল পরিমাণ জমি নেওয়ার নেপথ্যে কী কারণ, এরা কারা, বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকাজুড়ে এরা আসলে কী করতে চায়- এসব প্রশ্নের জবাবে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক কে এম তারিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কথিত লাদেন গ্রুপের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। অনেক বিলম্বে ওদের অপতৎপরতার সংবাদ পেয়েছি। ইতিমধ্যে সরেজমিন তদন্তের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে নাইক্ষ্যংছড়ির ইউএনওকে।'
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, 'কিছু লোকের আমার জেলার সীমানা দিয়ে বান্দরবানে যাতায়াতের কথা শুনেছি, এমনকি তাদের স্থানীয় লোকজন লাদেন গ্রুপ বলে থাকে- এটাও জেনেছি। আমি এ ব্যাপারে সজাগ রয়েছি এবং বিষয়টি নিয়ে বান্দরবানের জেলা প্রশাসকের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি।'
বিষয়টি নিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও তদন্ত করছেন বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, তারা এ ব্যাপারে শিকড় পর্যায়ের তদন্ত শুরু করেছে।
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া ও রামু উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা হচ্ছে বান্দরবানের লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা। কয়েক দিন ধরে এসব এলাকায় ঘুরেও লাদেন গ্রুপের কোনো প্রতিনিধির সাক্ষাৎ মেলেনি। তবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ইউএনও শামীম সোহেল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্থানীয় লোকজনের কাছে লাদেন গ্রুপ হিসেবে কিছু লোক পরিচিতি লাভ করেছে, এটা সত্যি। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা পেয়ে আমি তদন্তের কাজ শুরু করেই জেনেছি এটা। তারা এত বিপুল পরিমাণ জমি কেনই বা নিচ্ছে, তা অবশ্যই খুঁজে দেখা হবে।' তিনি বলেন, 'আমি ইতিমধ্যে আমার এলাকার হেডম্যানদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, ওরা আমার এলাকায় কিছু পুরনো রাবার বাগান গোপনে কিনে নিয়েছে। তবে ওদের সবচেয়ে বেশি জমি কেনার খবর পেয়েছি লামা উপজেলার সাঙ্গু মৌজায়।'
হঠাৎ কেন লাদেন গ্রুপ : 'মাঝেমধ্যে কিছু লোকের আনাগোনা চোখে পড়ে। তারা সবাই লম্বা আলখেল্লা পরা। মাথায় লম্বা চুল ও পাগড়ি। তাদের দেখে জঙ্গি মনে হয়। সম্ভবত এ কারণেই এলাকার লোকজনের কাছে তারা লাদেন গ্রুপ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে'- বান্দরবানের লামা বন বিভাগের সাঙ্গু বন রেঞ্জের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বনকর্মী এভাবেই বললেন। কক্সবাজারের রামু উপজেলার ঈদগড় বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নুরুল হুদা কালের কণ্ঠকে জানান, তাদের কিছু কর্মী অবস্থান করে গহিন অরণ্যে। সেখানে তাদের নেওয়া পাহাড়ি ভূমির উন্নয়নকাজের তদারকি করে থাকে তারা। অরণ্যের ভেতর শ্রমিক রয়েছে শত শত। শুক্র ও সোমবার ঈদগড়ের বাজার বসে। কেনাকাটার জন্য লাদেন গ্রুপের সদস্যরা বাজারে এলে তাদের দেখা যায়। তবে তারা সবাই অস্থানীয়, নানা জেলার বাসিন্দা। তারা সচরাচর স্থানীয় লোকজনকে এড়িয়ে চলে। এ গ্রুপের নেতা কে, এটা কারো জানা নেই। স্থানীয় শ্রমিক হিসেবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরাও তাদের সম্পর্কে বেশি জানাজানির চেষ্টা করলে তাঁদের কাজ করতে দেওয়া হয় না। এ কারণে সবাই এক প্রকার চুপচাপ থাকেন।
কক্সবাজার-বান্দরবানের সীমান্তে কেন : পার্বত্য তিন জেলায় ১৯৮৯ সাল থেকে দীর্ঘমেয়াদি ভূমি বন্দোবস্তি বন্ধ রয়েছে। নতুন করে রাবার বাগানের প্লট ইজারাও দেওয়া হচ্ছে না। পার্বত্য জেলায় ভূমির বেচাকেনায়ও বেশ কঠোরতা আরোপ করা রয়েছে। এর পরও বেচাকেনা থেমে নেই। তবে জেলা প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু জানা গেছে, লাদেন গ্রুপের ক্ষেত্রে এ রকম অনুমতির বালাই নেই। নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মনিরুল হক মনু বলেন, 'এ গ্রুপের সঠিক পরিচয় না থাকায় লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাদের নিয়ে আমরা সবাই অন্ধকারে রয়েছি। তারা যদি সত্যিকারের ব্যবসায়ী হয়, তাহলে জনসম্মুখে তাদের কেউ নেই কেন?'
ঈদগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ ভুট্টো বলেন, লাদেন গ্রুপের নামে যারা কক্সবাজার-বান্দরবান সীমান্তে কাজ করছে, তাদের ব্যাপারে প্রশাসনকে এক্ষুনি বিস্তারিত খোঁজখবর করা প্রয়োজন। একই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বাঙ্গালী বলেন, লাদেন গ্রুপের কর্মকাণ্ড সন্দেহজনক। তারা এত বিপুল পরিমাণে জমি কেন নিয়েছে, কী উদ্দেশ্য তাদের, এখানে কী করা হবে- এসব প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর আগেও এখানকার গহিন অরণ্যকে ব্যবহার করা হয়েছে নানা স্বার্থে। তিনি এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য জানতে চান সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
লাদেন গ্রুপের জমিজমা : কথিত লাদেন গ্রুপ বান্দরবানের পাহাড়ি জমি কেনা শুরু করেছে বেশ আগে থেকেই। কিন্তু এত দিন তাদের কর্মকাণ্ড চলেছে গোপনে। স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে তারা সখ্য গড়ে তুলে অত্যন্ত সুকৌশলে জমি কেনার কাজ শুরু করে। এ জন্য তারা বেশ কজন হেডম্যান ও মুহুরি নিয়োগ করে মাসিক মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালী লোকজনকেও গোপনে হাত করে তারা। লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের একজন সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে লাদেন গ্রুপের জমি কিনে দেওয়ার কাজে মুখ্য ভূমিকা পালনের অভিযোগ রয়েছে। খাইরুল বশর নামের ওই চেয়ারম্যানের সঙ্গে এ ব্যাপারে জানার জন্য বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি মুখ খুলতে রাজি নন। তাঁর সহযোগিতায় লামার ইয়াংছা মৌজার বনপুর এলাকা ছাড়াও চকরিয়ার ডুলাহাজারা এলাকায়ও লাদেন গ্রুপ বিপুল পরিমাণ জমি হাতিয়ে নিয়েছে। বনপুর এলাকায় লাদেন গ্রুপের কয়েকজন লোক অবস্থান করলেও তারা স্থানীয়দের সঙ্গে তেমন মেলামেশা করে না। লাদেন গ্রুপের জায়গা-জমি কেনার সঙ্গে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, তাদের জমির পরিমাণ পাঁচ হাজার একর ছাড়িয়ে গেছে। লামার সাঙ্গু মৌজা, ফাইতং, ইয়াংছা, ফাঁসিয়াখালী, আলীক্ষ্যং ও নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারি ও ঘুমধুম মৌজায় এ পরিমাণ পাহাড়ি জমি তারা কিনে নিয়েছে।
এমপি বলেন : বান্দরবানের এমপি বীর বাহাদুর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ব্যাপারটি আমার নজরে এসেছে অনেক দেরিতে। বান্দরবানে জমির ইজারা বন্ধ রয়েছে। জমির হাতবদলেও রয়েছে কঠোর আইন। এমন অবস্থায় কথিত লাদেন গ্রুপ কিভাবে এত জমির মালিক হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।'
আনিস হুজুর রহস্য : জানা যায়, আনিসুল হক ওরফে আনিস হুজুর ওরফে আনিস মোল্লা নামের একজন কক্সবাজার-বান্দরবান এলাকার জমি ও বনায়নের দায়িত্বে আছেন সংবাদ পেয়ে তাঁর সাক্ষাৎ নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিনের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস উদ্দিন বলেন, 'আমি ওই লোকের পরিচয় না জেনেই ঘর ভাড়া দিয়েছিলাম। লাদেন গ্রুপের লোকজন কোটি কোটি টাকার লেনদেন কিভাবে করে, সেটাই আমার প্রশ্ন।' তিনি আরো বলেন, 'লাদেন গ্রুপের নামে ওরা অনেক ব্যবসায় জড়িত। আসলে তাদের প্রকৃত পরিচয় আমারও জানা নেই। শুনেছি ওরা ব্রিকফিল্ডের ব্যবসা ছাড়াও বান্দরবানের পাহাড় থেকে পাথর আহরণের ব্যবসা, রাবার বাগানসহ নানা ধরনের বনায়নের সঙ্গেও জড়িত।'
তবে আনিস হুজুর মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভাই, আমি এখন ঢাকায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি। তাই আগামী সপ্তাহে যোগাযোগ করেন।'

No comments

Powered by Blogger.