রৌপ্যমুদ্রার আবিষ্কারে আমার কাঁপুনি শুরু হয়েযায়

সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৯৬ সাল থেকে উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান এবং ২০০০ সাল থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা করেছেন। মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠানের সঙ্গে ২০১১ সালে রচনা করেছেন উয়ারী বটেশ্বর শেকড়ের সন্ধানে গ্রন্থ।


 আপনাদের লেখা বইটি প্রকাশের পর উয়ারী-বটেশ্বরে নতুন কিছু পেয়েছেন বা অগ্রগতি হয়েছে?
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান: জানখারটেকে আবিষকৃত বৌদ্ধবিহারের পুরোটা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এটি এখন সবার দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। আশা করছি, ১০-১৫ দিনের মধ্যেই প্রচারমাধ্যম ও পণ্ডিতগণের সবাইকে দেখাতে পারব। উৎখননের ক্ষেত্রে এটি অনেক বড় অগ্রগতি বলে মনে করি।
 এই আবিষ্কার ঐতিহাসিকভাবে নতুন কিছু সংযোজন করছে কি?
সুফি: অবশ্যই কিছু সংযোজন করছে, বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধতর করছে। আমরা তো বলেছি, উয়ারী-বটেশ্বরে আড়াই হাজার বছর আগে মানুষের বসতি ছিল। বৌদ্ধবিহারটি আবিষ্কার হওয়ায় এসব ঘটনাকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হচ্ছে।
 নতুন কিছু পেয়েছেন, গত দুই বছরের উৎখননে?
সুফি: টঙ্গীরটেক-এ আমরা খনন শুরু করেছি। সেখানে ইট-নির্মিত স্থাপত্যের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। আশা করছি, এখানে বড় ধরনের কোনো স্থাপত্য লুকিয়ে আছে, যা খনন করতে কমপক্ষে পাঁচ বছর লাগবে। এটি আবিষ্কৃত হলে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন তথ্য সংযোজিত হবে, যা হবে অনেক বড় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
 নতুন কিছু পাওয়ার পর আপনার অনুভূতি কেমন হয়?
সুফি: ২০০০ সালে রোলেটেড মৃৎপাত্র পাওয়ার পর আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। হাবিবুল্লা পাঠান স্যার উৎখনন স্থলে এলে আমি তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করেছি। চোখ দিয়ে সেদিন আনন্দাশ্রু পড়েছিল। আরেকটি ঘটনা, ২০০৪ সালে ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রার ভান্ডার আবিষ্কারের পর আমার কাঁপুনি শুরু হয়েছিল। রাতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারেনি। আমি আর হাবিবুল্লা পাঠান স্যার সে রাতে স্কুলের পাশের বাঁশবাগানে উয়ারী-বটেশ্বর নিয়ে কথা বলে রাত পার করেছি। আনন্দ-ভয়ের সেই অনুভূতি প্রকাশ করার মতো নয়। বারবার মনে হচ্ছিল, এই অমূল্য ঐতিহাসিক প্রত্নবস্তু আমরা কোথায় রাখব?
 দলের অন্যদের অনুভূতি কেমন থাকে?
সুফি: শিক্ষার্থী ও ঐতিহ্য অন্বেষণের গবেষক সবাই খুবই আনন্দিত হয়। প্রতিদিনই কিছু না কিছু আবিষ্কার হয়, যার আনন্দে দলের সবাই কায়িক ও মানসিক যে শ্রম, তার কষ্ট ভুলে যায়। এ ধরনের কাজ তো অনেক বেশি কষ্টকর। প্রাপ্তির আনন্দই সব কষ্টকে দূর করে দেয়।
 ওই স্থানের প্রতি আপনাদের আগ্রহ নিশ্চয় প্রতিদিনই বাড়ছে।
সুফি: আগ্রহ বাড়ছে, আবার ভালোবাসার বন্ধনেও জড়িয়ে পড়েছি। ঢাকার নাগরিক জীবনের জটিলতায় ওই জায়গাটা অনেক বেশি নির্জন ও আনন্দদায়ক। আমাদের ক্যাম্প বটেশ্বর স্কুলে ভালো ঘুম হয়। তৃপ্তির ঘুম আমি ওখানেই ঘুমাই।
 উৎখননের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলুন।
সুফি: উয়ারী-বটেশ্বর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্নস্থান, যার খননকাজ অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও জটিল। এ কাজে আমরা সীমিত আকারে আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছি। কিন্তু অর্থ সংগ্রহে যে শ্রম ও সময় যায়, তাতে গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবনে সময় নির্ধারিত। এর মধ্যে অর্থের পেছনে যদি বেশি সময় চলে যায়, তাহলে গবেষণা কখন হবে? এসব করতে গিয়ে ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। ট্র্যাজিক পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। আমরা শেকড়ের সন্ধান করছি। অথচ বিভিন্ন জায়গায় আমাদের নাজেহাল হতে হয়, যা গবেষণাকে বাধাগ্রস্ত করে।
 এই স্থান সম্পর্কে আপনার আগ্রহের নেপথ্য কারণ কী?
সুফি: আমি পুণ্ড্রনগর নিয়ে পিএইচডি করেছি। ১৯৯৯ সালে কাজটি শেষ করে ২০০০ সালে উয়ারী-বটেশ্বর যাই এবং উৎখননকাজ শুরু করি। দেশের কাজ করতে গিয়ে একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। সেটা পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ কাজের সফলতায় অনেকেই জড়িত। আমি শুধু পরিচালনা করছি। সুতরাং উয়ারী-বটেশ্বরের তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কারের সকল অর্জন আমি সব সময় সবার সঙ্গে ভাগ করে নিই, যা আমি বইয়ে লিখেছি এবং সব জায়গায় বলেও থাকি।

No comments

Powered by Blogger.