বাঘা তেঁতুল-ধর্মাবতারের মাতৃস্নেহ by সৈয়দ আবুল মকসুদ

সন্তানের প্রতি মাতৃস্নেহ এমন জিনিস, যার কাছে লাজলজ্জা, মান-অপমান তুচ্ছ শুধু নয়, মৃত্যুবরণও অতি সহজ। খেলতে খেলতে ছাদ থেকে কারও ছেলে বা মেয়ে পা ফসকে পড়ে যাচ্ছে নিচে। তাকে বাঁচাতে মা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে পারেন। জাহাজের রেলিং গলে সন্তান পড়ে গেছে সমুদ্রে।


এই জগতে একমাত্র মা-ই পারেন তাকে উদ্ধারের আশায় উত্তাল সাগরে ঝাঁপ দিতে। সন্তানকে বাঁচাতে পারবেন কি পারবেন না, সে কথা ভাবার অবকাশ এই ভবসমুদ্রে কোনো মায়েরই নেই। সন্তান যখন বিপদে পড়েছে, তখন ওই মুহূর্তে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা ছাড়া আর কোনো কিছুই ভাবা সম্ভব নয় কোনো মায়ের পক্ষে।
বাংলার মাটিতে মাতৃস্নেহের পরিমাণ পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। আর সন্তান যদি হয় পুত্র, তাহলে মাতৃস্নেহ ডাবল। সেটা আমার থিওরি নয়। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলে গেছেন।
এসিড আইনে দায়ের করা মামলায় গুলশান থানার পুলিশ গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে। ‘গ্রেপ্তারের পর পরই ওই যুবকের মা হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী তাকে ছাড়িয়ে নিতে থানায় আইনজীবী নিয়ে হাজির হন।... তিনি ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ওসিকে বলেন। কিন্তু পুলিশ এভাবে ছাড়তে অপারগতা জানালে তিনি চলে যান।’ [প্রথম আলো] ‘ধারণা করা হচ্ছে, ত্রিভুজ প্রেমের জের ধরে এসিড নিক্ষেপের ঘটনাটি ঘটে।’ [সমকাল] ‘পুলিশের দাবি, প্রেমঘটিত বিষয় নিয়ে বিরোধের জের ধরে সাফায়াতের নির্দেশে এসিড হামলা চালানো হয়,..গ্রেপ্তারের খবর শুনে সাফায়াতের মা, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুসহ স্বজনেরা থানায় ছুটে যান।’ [কালের কণ্ঠ]
বিপদে-আপদে স্বজনের পাশে থাকাই স্বজনদের কাজ। যে কারও পুত্র এভাবে গ্রেপ্তার হলে মা ছুটে যেতেন থানায়। যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে সে মা যেতেন ছেলের জন্য নাশতা নিয়ে। মস্ত টিফিন ক্যারিয়ারে থাকত গোটা চার-পাঁচ পরোটা, দুটো ডিমের অমলেট বা পোচ, আধা কেজি ভুনা খাসির মাংস (এখন গরুর অ্যানথ্রাক্স রোগ হওয়ায় গরুর গোসতের দোপেঁয়াজি বা কাবাব না থাকারই কথা), ফ্লাস্কে চা বা কফি প্রভৃতি। কিন্তু এই মামলায় মা গিয়েছিলেন ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে। পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়েননি। শাস্তি হিসেবে জেলের ভাত না খেলেও নাইক্ষ্যংছড়ি বদলি হন কি না বলা যায় না।
মানুষ অপরাধপ্রবণ প্রাণী। কে কখন কী কারণে অপরাধ করবে, তা কেউ বলতে পারে না। সন্তানের অপরাধের জন্য মা-বাবা দায়ী নন। কারও অপরাধের জন্য তাঁর নানা-নানি, দাদা-দাদি, চাচা-মামাও দায়ী নন। নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি ম্যাকগাথাও ম্যান্ডেলা হেরোইনসহ ভারতে ধরা পড়েছিলেন। তাঁর জেল হয়েছিল। জেলেই তিনি মারা যান। নাতির জন্য ম্যান্ডেলা প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িকে ফোন করেননি। আমেরিকা, স্পেন, নরওয়ে, ভারত বা জাপানের উচ্চ আদালতের কোনো বিচারপতির ছেলে এসিড মারার ঘটনায় ধরা পড়লে মাননীয় বিচারপতি আইনজীবীদের নিয়ে থানায় গিয়ে হাজির হতেন কি না? এভাবে মাননীয় বিচারপতির পদে থাকা অবস্থায় থানায় যাওয়া নৈতিক দৃষ্টিতে কতটা সমর্থনযোগ্য, এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
মামলার বিচার শেষ হওয়া তো দূরের কথা, অভিযুক্তের আটকের সময়ই বেকসুর খালাস পাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এরই মধ্যে তিনি জামিনও পেয়ে গেছেন। তার পরও হয়তো এখন কিছুটা কোর্ট-কাচারি হবে। কিন্তু ফরিয়াদি ন্যায়বিচার পাবেন কি?
বিশেষ কারণে বিশেষ মামলায় বিচারকের বিব্রত হওয়ার নজির বহু দেশেই আছে। কিন্তু বাংলাদেশেই বিচারপতিদের বিব্রত হওয়ার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এ মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কয়েক দিন ধরে বাংলার মাটিতে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার শুরু হয়ে গেছে। পত্রিকা পড়ে মনে হচ্ছে, দেশে আর বেআইনের কুশাসন থাকবে না। অন্যায়-অবিচার লুপ্ত হয়ে যাবে। দেশ কলি যুগ থেকে এক লাফে ফিরে যাবে সত্য যুগে।
আমরা সাধারণ মানুষ। নিজের বুঝটাই ভালো বুঝি। ন্যায় আর অন্যায় আমাদের কাছে সমান। বেআইনের শাসনটাই যদি আমাদের স্বার্থের অনুকূল হয়, তাহলে সেটাই বিনা দ্বিধায় সমর্থন করব। ন্যায়বিচারের পরিবর্তে অন্যায়বিচারে যদি লাভবান হই, সেটাই চাইব। কিন্তু দাঁড়িপাল্লা প্রতীক চিহ্নিত ঘরে উচ্চতম আদালতে যাঁরা বিচারকের আসনে আসীন, তাঁদের কাছে একমাত্র ন্যায় আচার ও ন্যায়বিচারই আমাদের প্রত্যাশা।
রাষ্ট্রের কোনো কোনো আসন শুধু একটি পদ মাত্র নয়। তার মর্যাদা অতি উঁচু। ওই আসনে বসলে ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন দিতে হয়। বহুকাল ধরে উপমহাদেশে আদালতের বিচারককে সম্বোধন করা হতো ‘ধর্মাবতার’ বলে। ইংরেজরা এসে যোগ করেন ‘মাই লর্ড’। সনাতন ধর্মের আইনশাস্ত্র স্মৃতিতে আইনের অপর নাম ধর্ম। তাই ধর্মাবতার হলেন আইন রক্ষার জন্য বিধাতার অবতারবিশেষ। আজ আমাদের অনেক ধর্মের অবতারের অধঃপতন ঘটেছে দেখে শোক হয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.