নারায়ণগঞ্জে আ.লীগ কার্যালয়ে বোমা হামলার ১১ বছর-মুফতি হান্নান, পিন্টুসহ ১৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র হচ্ছে by আসিফ হোসেন

নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বোমা হামলার ১১ বছর পূর্তি কাল শনিবার। কিন্তু এখনো এই হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। তবে সিআইডি জানিয়েছে, মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। অভিযোগপত্র প্রস্তুত করার কাজ চলছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, একই সংগঠনের আনিসুল মুরসালিন ও মহিবুল মুত্তাকিম, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিএনপিদলীয় সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক দল নারায়ণগঞ্জ নগর কমিটির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, নারায়ণগঞ্জের উত্তর চাষাঢ়ার বাসিন্দা ওবায়দুল হক, স্থানীয় বিএনপির সমর্থক শাহ আলম, মাসুদ রানা, মোস্তফা আল জুমলা, জহিরুল হকসহ ১৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। তাঁদের মধ্যে শেষ পাঁচজনকে ওই বোমা হামলার পর সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে তখন কোনো তথ্য বের করতে পারেনি। পরে তাঁরা জামিনে মুক্তি পান।
তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির নারায়ণগঞ্জ জেলার সহকারী পুলিশ সুপার এহসান উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
২০০১ সালের ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ওই বোমা হামলায় ২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন।
ঘটনার পরপরই শহর আওয়ামী লীগ ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন। মামলায় তৈমুর আলম খন্দকারসহ বিএনপি-জামায়াতের স্থানীয় ২৭ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। পরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৩ সালে সিআইডি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলে মামলা দুটির অপমৃত্যু ঘটে।
২০০৯ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। এরপর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল নারায়ণগঞ্জের বোমা হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। তিনি ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে লিখিতভাবে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে থেকেই অত্যধিক মাদক সেবনের কারণে জুয়েল অসুস্থ হয়ে বাকশক্তি হারান। এ কারণে তিনি আদালতে লিখিত জবানবন্দি দেন। জুয়েল র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত নারায়ণগঞ্জের শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী মমিনউল্লাহ ডেভিডের ছোট ভাই।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মূলত জুয়েলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করেই অভিযোগপত্র তৈরি হচ্ছে। এতে আওয়ামী লীগের নেতা শামীম ওসমানসহ ৩০ জনকে সাক্ষী করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে ১৬ জন বোমার আঘাতে আহত হয়েছিলেন।
মামলার বাদী খোকন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই, নৃশংস এই গণহত্যাকারীদের বিচার হোক। তবে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হয়। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত খুনিদের বিচার দাবি করছি।’
শামীম ওসমানের জবানবন্দি: এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে শামীম ওসমান সিআইডিকে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, ওই রাতে তাঁর পূর্বনির্ধারিত গণসাক্ষাৎ কর্মসূচির পাশাপাশি দেওভোগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনার জন্য দলীয় নেতা-কর্মীরা দলীয় কার্যালয়ে ছিলেন। রাত সোয়া আটটার দিকে উত্তর চাষাঢ়ার ওবায়দুল হক এসে তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদনপত্রে সুপারিশ করার জন্য শামীম ওসমানকে অনুরোধ করেন। শামীম ওসমান তাঁকে বলেন, ঢাকার মার্কিন দূতাবাস সাংসদদের সুপারিশে ভিসা দেয় না। তার পরও ওবায়দুল হক সুপারিশের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। এ সময় সেখানে দুই যুবক আসেন। তাঁদের একজনের হাতে ছিল কালো ব্রিফকেস। দুই যুবক ফটোকপি করা একটি আবদেনপত্রে শামীম ওসমানের সুপারিশসহ সই চান। এর মধ্যে ওবায়দুল হক দ্রুত বেরিয়ে যান।
জবানবন্দিতে শামীম ওসমান বলেন, তিনি ওই যুবকদের বলেন যে ফটোকপিতে সুপারিশ করা যায় না। তখন তাঁরা ব্রিফকেসটি সেখানে রেখে মূল দরখাস্ত আনার কথা বলে বাইরে যান। এ সময় সিগারেটের তেষ্টা পাওয়ায় শামীম ওসমান তাঁর ব্যক্তিগত সচিব চন্দন শীলকে আগত লোকজনের কাগজপত্র দেখার কথা বলে চেয়ার ছেড়ে পাশের ছোট কক্ষে যান। এর পরপর ব্রিফকেসে থাকা বোমাটি বিস্ফোরিত হয়।
মুরসালিন-মুত্তাকিম শনাক্ত: সিআইডি সূত্র জানায়, তারা জানতে পারে, ভারতে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে দিল্লির তিহার জেলে থাকা দুই বাংলাদেশি জঙ্গি মুরসালিন ও মুত্তাকিম ওই দেশের পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, নারায়ণগঞ্জের বোমা হামলাসহ বিভিন্ন হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। পরবর্তী সময়ে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় তাঁদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলায় তাঁদের আসামি করা হয়েছে। এরপর সিআইডি তাঁদের ছবি শামীম ওসমানকে দেখালে তিনি শনাক্ত করেন যে এই দুজনই তাঁর কাছে কালো ব্রিফকেস নিয়ে এসেছিলেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, ব্রিফকেসে রক্ষিত বোমাটি দূরনিয়ন্ত্রণযন্ত্রের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটনানো হয়েছে। আর ব্রিফকেস বহনকারী মুরসালিন ও মুত্তাকিমকে ৭ নম্বর উত্তর চাষাঢ়ার ওবায়দুল হকের বাসায় আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। যমজ দুই ভাই মুরসালিন ও মুত্তাকিমের বাড়ি ফরিদপুর শহরে।
নিহত ২০ জন: ২০০১ সালের ১৬ জুন শনিবার রাত পৌনে নয়টায় নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ওই বোমা হামলায় ২০ জন নিহত হন। তাঁরা হলেন: স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা এ বি এম নজরুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, মহিলা আওয়ামী লীগের পলি বেগম, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা সাইদুর রহমান, ছাত্রলীগের সাইদুল হাসান, স্বপন দাস, যুবলীগের নিধুরাম বিশ্বাস, আবদুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েত উল্লাহ, আবদুল আলীম, শুক্কুর আলী, স্বপন রায়, সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন ও তাঁর ভাই মোশাররফ হোসেন, বাংলাদেশ হোসিয়ারি সমিতির কার্যকর কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, সিদ্ধিরগঞ্জের ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, পান-সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম ও অজ্ঞাত এক নারী।
এ ঘটনায় শামীমের ব্যক্তিগত সচিব চন্দন শীল, যুবলীগের নেতা রতন দাস দুই পা হারিয়ে পঙ্গু জীবন যাপন করছেন। বোমা হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের ১১ বছরেও বিচারের মুখোমুখি করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

No comments

Powered by Blogger.