গতকাল সমকাল-কবরনামা by ফারুক চৌধুরী

জীবনের সঙ্গে মৃত্যু তথা সমাধির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আমরা সবাই মৃত্যুপথযাত্রী কাফেলায় এগিয়ে চলেছি অভিন্ন গন্তব্যের পানে। আর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু সম্বন্ধে ঔৎসুক্য বাড়ছে। মৃত্যুকে নিয়ে সুফি-সাধক আর গুণীজনের অমৃত বচনের নিগূঢ় তাৎপর্য সাগ্রহে অনুসন্ধান করি।


কবি কাহলিল জিব্রানের উক্তি স্মরণ করি। কবি বলেছেন, ‘নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসই তো জীবনস্রোতের অস্থিরতা থেকে নিঃশ্বাস বায়ুকে মুক্ত করে; যাতে তা উত্তোলিত আর সম্প্রসারিত হয়ে সৃষ্টিকর্তার অন্বেষণ করে। যখন তুমি নিস্তব্ধ তটিনী থেকে পান করো, তখই তো বেজে ওঠে সংগীতের মূর্ছনা; ধরিত্রী যখন তোমার অঙ্গপ্রতঙ্গ বরণ করে নেয়, তখনই তো তুমি প্রকৃত অর্থে নৃত্যরত।’ সংগীত। নৃত্য। পুলকজাগানিয়া বটেই জিব্রানের মরণদর্শন।
সৃষ্টিকর্তার প্রেমে নিমজ্জিত জালালউদ্দিন রুমি বলেছেন, ‘...তুমি আর আমি। আমাদের দুজনের সম্মিলিত হাস্যের কলধ্বনিতে মনে হবে, স্বর্গের তোতা পাখিরা যেন চিনির দানা খুঁটছে একভাবে এই ধরায়, আর অন্যভাবে চিরন্তন মাধুর্যে ভরা সেই ভুবনে। তুমি আর আমি।’ জীবনে-মরণে সৃষ্টিকর্তার জন্য গভীর ভালোবাসা। ঐশ্বর্যময়। মহান।
আল্লামা ইকবাল তো সৃষ্টিকর্তাকে সাবধান করছেন। অভিমানেই বলছেন, ‘বেহেশতের বাগিচা থেকে পথচলার আদেশ কেন তুমি দিয়েছিলে? এই ধরায় আমার দায়িত্ব যে অপূর্ণ রয়ে গেছে। এখন তুমি অপেক্ষায় থাক।’ জানা নেই, দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল তাঁর দায়িত্ব সম্পাদনের পূর্ণতার সন্তুষ্টিতে চিরনিদ্রায় শায়িত কি না।
কবরের সঙ্গে আমার পরিচিতি সেই বয়স থেকে, যখনো মনে মৃত্যুভয় জাগেনি। বাবার হাত ধরে সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার বারকোট গ্রামে আমাদের আদিবাড়ির সন্নিকটস্থ টিলার ঢালুতে পারিবারিক গোরস্থানে গিয়েছি। বাবার দেখাদেখি হাত তুলে মোনাজাত করেছি তাঁদের রুহের মাগফিরাতের জন্য, যাঁদের কখনো দেখিনি; আর যাঁরা আমাকে এই ধরায় কোনো দিনও দেখবেন না। মোনাজাতের কথাগুলো গুলিয়ে ফেলে ঠোঁট বিড়বিড় করেছি, যাতে আমার ওষ্ঠ সঞ্চালন বাবাকে আশ্বস্ত রাখে। দিনের বেলা ভালোই লাগত টিলার ঢালুর সূর্যস্নাত, বর্তমানে প্রায় পরিত্যক্ত, সেই কবরস্থানটি। গ্রামের বিজলিবিহীন রাতের ঝিঁঝিঁডাকা ঘুটঘুটে অন্ধকারে, কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িতদের সম্বন্ধে ভীতি জাগত মনে। যদি কবরের ওপর কোলাব্যাঙ লাফ দেয়। যদি সাপ হেঁটে যায় এঁকেবেঁকে। কিন্তু ঢাকা শহরে বেড়ে ওঠা কৈশোর আর যৌবনে মৃত্যু আর সমাধি ধারণ করল অন্য এক রূপ। প্রত্যক্ষ করলাম যে এ দেশের রাজনৈতিক বিবর্তনের সঙ্গে রয়েছে কবরস্থানের নিবিড় সম্পর্ক। সেই উপলব্ধিতে এর আগে লিখেছি, ‘আন্দোলন, নিষ্পেষণ, দাঙ্গা, মিছিল, পুলিশ, মিলিটারি, গুলি, সংগ্রাম, যুদ্ধ, মৃত্যু, কবরস্থান একই সুতোয় বাঁধা। বিবর্তনমান একই বৃত্তের পরিধিতে তাদের অবস্থান। তাই তো তারা বারবার ফিরে আসে জাতীয় জীবনে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়।’ আর এখন সহিংসতায় সংযোজিত প্রতিটি কবরই যেন হতাশার উৎস।
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে যাযাবর তাঁর দৃষ্টিপাত-এ লিখেছিলেন, ‘মুসলমানেরা তাদের প্রিয়তম, প্রিয়তমার স্মৃতিকে করতে চেয়েছে কালজয়ী, রাখতে চেয়েছে স্মারকচিহ্ন। তাই সৌধ গড়ছে পিতার, পতির, পত্নীর এমনকি উপপত্নীর সমাধিতে। হিন্দুরা তপস্বী, তারা দিয়েছে বেদ ও উপনিষদ। মুসলমানেরা শিল্পী, তারা দিয়েছে তাজ ও রংমহল।’ কথাটি নিয়ে হয়তোবা যুক্তিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তাতে কিছু এসে-যায় না। যাযাবরের অপূর্ব ভাষাশৈলীর উৎকর্ষের মুখোমুখি যুক্তিতর্ক অবান্তর। তবে মূলত তাঁর লেখনীসৃষ্ট আগ্রহের টানে পশ্চিমের সমরখন্দে পঞ্চদশ শতাব্দীর ভুবন কাঁপানো তৈমুরের সমাধি ‘গোর আমির’ থেকে শুরু করে পূর্বে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে তাঁরই বংশের অন্তিম নৃপতি, ইংরেজ-প্রতারিত এবং তাদের দ্বারাই ঊনবিংশ শতাব্দীতে গোপনে সমাহিত অসহায় বাহাদুর শাহ জাফরের অতি সাধারণ সমাধিটি দেখেছি। তৈমুরের সমাধিতে অন্যদের মধ্যে সমাহিত রয়েছেন তৈমুরের সন্তান আর বাবরের প্রো-প্রো-পিতামহ মিরান শাহ। মধ্য এশিয়ায় তৈমুরের সমাধি দর্শনে সেই যুগের কবি আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে যদি কোনো দিন আকাশ অপসৃত হয়, তাহলে সমাধির গম্বুজটি তো রয়েছেই। সাধারণ দর্শকের কাছে গম্বুজটি আকাশের মতো অনন্ত নয়, তবে অনন্যসুন্দর। গম্বুজের নিচের কবরগুলো হলো আরও নিচের আসল কবরগুলোর হুবহু সংস্করণ (replica), যেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে ইতিহাস-সচেতন পর্যটকেরা সময় ও সুযোগে সমাধির প্রহরীর বদান্যতায়, মাত্র এক আমেরিকান ডলারের বিনিময়ে একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিচের কবরগুলো সঙ্গোপনে দেখতে পারেন। আর পূর্ব এশিয়ায় বাহাদুর শাহ জাফরের দীর্ঘশ্বাসে, যাঁর সুদীর্ঘ জীবনের অর্ধেক কেটেছে বাসনায়, আর বাকি অর্ধেক অপেক্ষায়; ধরা আছে হতভাগ্য এই সম্রাটের জীবনব্যথা।
উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর শায়িত রয়েছেন কাবুলের অনতিদূরের ‘বাগ এ বাবর’-এ। আফগানিস্তানে যুদ্ধের বুলেটে ঝাঁঝরা সংস্কারাধীন বাবরের সমাধিটি দেখে কবির উচ্ছ্বাস মনে এসেছিল, ‘এ ধরায় যদি স্বর্গ থাকে কোনখানে, এইখানে তা এইখানে।’ বর্তমানের আফগানিস্তান নরকের সঙ্গে তুলনীয়, স্বর্গের নয়। দিল্লির ব্যস্ততায় কিছুটা অবহেলায় শায়িত রয়েছেন হুমায়ুন, সেকেন্দ্রার ‘নীরব শ্মশানে’ আকবর, লাহোরে ওয়াহাবি আক্রমণের আতঙ্কে জাহাঙ্গীর, আগ্রায় তাজমহলে মমতাজের পাশে, মূলত তাঁর জন্য অনির্ধারিত স্থানে সমাহিত রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সম্রাট কবি’ শাহজাহান আর ভারতের দক্ষিণাত্যের ঔরঙ্গবাদে শহরতলির নিরিবিলি সাধারণতায় আওরঙ্গজেব।
সমরখন্দ থেকে ইয়াঙ্গুন। একই পরিবারের প্রতিভূদের সমাধিসৌধগুলো দুটি কথা স্মরণ করায়। সমাধিসৌধ নির্মাণে তাঁদের অসীম আগ্রহ সত্ত্বেও কোনো মোগল সম্রাটই জীবদ্দশায় সম্পন্ন করেননি তাঁদের নিজস্ব স্মৃতিসৌধ। সেই দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের উত্তরসূরিরা। আর মনে আসে মার্ক টোয়েনের উচ্চারিত নিগূঢ় সত্যটি, Death is a great leveller—অর্থাৎ মৃত্যু সমতা আনয়নকারী।
বাংলাদেশের বিদ্যমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে কবর নিয়ে আলোচনার নাগরিক দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও স্বাধীনতা-উত্তর হত্যার রাজনীতির নীরব সাক্ষী দেশভর ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমি, গণকবর, কবরস্থান আর স্মৃতিসৌধ। এগুলো বাদ দিলে বাংলাদেশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায় কবরভূমির দুষ্প্রাপ্যতা ও উচ্চমূল্য মৃত্যু উদ্ভূত সমস্যাকে করে তুলেছে জটিল থেকে জটিলতর। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় তা প্রতিফলিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ জানুয়ারি একটি মোটর দুর্ঘটনায় বাবার অকালমৃত্যু ঘটে। তখন আজিমপুর গোরস্থানে কবর ছিল সহজলভ্য। মূল্য ছিল দেড় হাজার টাকা। বাবাকে সমাহিত করার সময় আমার ভগ্নিপতি কর্নেল সৈয়দ আবদুল হাই বাবার কবরের পাশেই কিনে নিলেন তাঁর শাশুড়ি অর্থাৎ আমার মায়ের জন্য কবরের স্থান। দেশের রাজনৈতিক বিবর্তন আমাদের সবাইকেই স্পর্শ করে। বাবার মৃত্যুর ঠিক দুই মাস পর ৩০ মার্চ ১৯৭১, অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভেই শহীদ হলেন কর্নেল হাই। আপ্রাণ চেষ্টায় তাঁর মৃতদেহটি প্রত্যর্পিত হলো। কড়া শর্তে। লোকসমক্ষে শোক প্রকাশ করা যাবে না এবং প্রয়োজনবোধে আমাদের বাসস্থানেই করতে হবে তাঁকে দাফন। নিয়তির পরিহাস, সেই ভয়াবহ অবস্থায় শহীদ কর্নেল হাইকে দাফন করা হলো আমার মায়ের জন্য তাঁরই কেনা কবরে। প্রায় এক ডজন পাকিস্তানি সেনা পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাঁর মরদেহ আজিমপুর গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। মৃত ব্যক্তিটি তাদের বিচারের ‘গাদ্দার’ অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতক বলে পাকিস্তানি সেনারা শরিক হলো না তাঁর জানাজায়। এভাবেই সেই বিষাদমাখা থমথমে আতঙ্কভরা সন্ধ্যায় বাংলার মাটি বরণ করে নিল মায়ের জন্য সংরক্ষিত সন্তানতুল্য তাঁর শহীদ জামাতার মৃতদেহ।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতেই আজিমপুর গোরস্থানে জমি পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল। তবে কবরস্থানটির গোড়াপত্তনের সময়ে দুটি কবরের মাঝামাঝি যথেষ্ট ব্যবধান রাখা ছিল, তবে সেখানে একটি তৃতীয় কবরের স্থান সংকুলান ছিল সম্ভব। তখন আমার মরণাপন্ন মায়ের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে এই দরখাস্ত করা হলো, সময় এলে তাঁকে যেন বাবার পাশে সমাধিস্থ করার অনুমতি দেওয়া হয়। অপ্রত্যাশিত কম সময়ের মধ্যে পাওয়া অনুমোদনটির বক্তব্য বিশ্লেষণ না করেই তা সযত্নে সংরক্ষিত করা হলো। মাতৃবিয়োগের বেদনা তা কিছুটা হালকা করল, কিন্তু তা স্বল্পক্ষণেরই জন্য। আমরা আবিষ্কার করলাম যে অনুমোদনের পত্রটি হূদয়হীন আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কারণ তাতে বাবার কবরের ‘পাশে’ নয়; ‘ওপরে’ আম্মাকে সমাহিত করার অনুমতি রয়েছে।
নগর ভবনে একদার সহকর্মী তদানীন্তন মেয়র হানিফের শরণাপন্ন হলাম। স্বাধীনতার পর তিনি যখন বঙ্গবন্ধুর সহকারী ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন, আমি তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সহূদয় হানিফ নিয়ম ঘেঁটে জানালেন, সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত মূল্য জমা দিলে পুরোনো দুই কবরের মাঝামাঝি স্থানে একটি তৃতীয় কবর নির্মাণ করা সম্ভব। আম্মাকে নিয়ে সমস্যাটির সমাধান অবশেষে পাওয়া গেল, যা আগের পাওয়া অনুমোদনপত্রে উল্লিখিত থাকা উচিত ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে কবরভূমি প্রাপ্তি হয়েছে ভয়াবহভাবেই প্রকটতর। একদিন এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু টেলিফোন করল যে কোথাও সে পাশাপাশি চারটি কবরের জায়গার সন্ধান পেয়েছে। কবরপ্রতি ৯০ হাজার টাকায় আমার এবং আমার স্ত্রীর জন্য দুটো কবর আমি নিতে পারি। রসিক বন্ধুবর প্রলোভন দেখিয়ে বলল যে জায়গাটির অবস্থান নান্দনিক! কিন্তু অগ্রিম মূল্যের বিরাট অঙ্কটি সেই মুহূর্তে আমাকে নিরুৎসাহিত করল। প্রত্যাখ্যান করলাম তার সদয় প্রস্তাবটি। আজ আমার সেই বন্ধুটি সেই ‘নান্দনিক’ অবস্থানের একটি কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত।
এর বছর কয়েক পরের অন্য একটি ঘটনা আমার উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিল। কূটনৈতিক মহলের সুপরিচিত এবং মেধাসম্পন্ন অনুজপ্রতিম একজন সহকর্মী অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করল। তার বাড়িতে শোক প্রকাশের জন্য যেতেই সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন তার সদ্যবিধবা স্ত্রী, আমি যেন তাঁর প্রয়াত স্বামীর কবরের জন্য একটি স্থান এক দিনের মধ্যেই জোগাড় করি। দুরূহ দায়িত্ব। তবে এ কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে টেলিফোন করলাম মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে। প্রয়াত হানিফের মতোই সমবেদনা প্রকাশ করলেন সাদেক হোসেন খোকা এবং বেলা তিনটার মধ্যে বন্দোবস্ত করে দিলেন কবরের জন্য একটি স্থান। মুক্ত করলেন আমাকে সুকঠিন একটি দায়িত্ব থেকে। কিন্তু তার পরই আমার উৎকণ্ঠা বহুগুণ বৃদ্ধি পেল। প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ আর সাদেক হোসেন খোকার সৌজন্যে আমি দুবার আমার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আমার বেলায়? আমার স্ত্রীকে আগামী কোনো মেয়রের বদান্যতার ওপর নির্ভরশীল করে চিরবিদায় নেওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না। বহুমুখী প্রচেষ্টায় অবশেষে একটি স্থান (নান্দনিক নয় মোটেও) আমি পেলাম। আয়তন—দৈর্ঘ্যে আট ফুট এবং প্রস্থে চার ফুট। মূল্য তিন লাখ টাকা অর্থাৎ প্রতি বর্গফুট নয় হাজার ৩০০ টাকারও ওপরে। সোনার চেয়েও খাঁটি আমার দেশের মাটিটি অতি মূল্যবান। তাকে রক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। তাই কবরটির চারপাশে ইট দিয়ে বেঁধে দিলেই আমার এই ধরার দায়িত্ব পূর্ণ হবে! মজুর কাজটির জন্য আট হাজার টাকা দাবি করল। মনে হলো, দরাদরির অবকাশ রয়েছে। বললাম, ছয় হাজার টাকা। মজুরের পাল্টা প্রস্তাব, আট হাজার টাকা দিলে প্রস্থে চার ইঞ্চি করে দুই ধারে সে আট ইঞ্চি বাড়িয়ে দেবে! এও বলল যে তাহলে আমার নিজের শারীরিক আয়তনের বিচারে আমাকে অন্তিম শয্যায় শায়িত করা সহজতর হবে! মরণকালে এসে ভূমিদস্যুদের দলে যোগ দেওয়ার প্রবৃত্তি হলো না।
হালে একটি ‘ডেভেলপমেন্ট’ কোম্পানি থেকে টেলিফোন পেলাম। তাদের প্রশ্ন, ‘ডেভেলপমেন্টের’ জন্য কোনো জমি আমার আছে কি না। বললাম, ‘আছে’। কোথায়? ‘আজিমপুরে’। আজিমপুরে কোথায়? কোম্পানিতে কর্মরত মহিলার প্রত্যাশাভরা প্রশ্ন। তাঁকে যখন গোরস্থানে আমার ৩২ বর্গফুট জমির কথা বললাম, তখন তিনি রসিকতাটি বুঝতে পেরেই মন্তব্য করলেন, ৩২ বর্গফুট জমি ডেভেলপমেন্টের জন্য রাজউকের অনুমতি পাওয়া অসম্ভব। তখন তাঁকে বললাম, আমার মৃত্যুর পর (যার জন্য খুব বেশি অপেক্ষা হয়তো করতে হবে না) তাঁরা যদি আমার কবরটি বিনা মূল্যে বাঁধিয়ে দেন, তাহলে আমার লিখিত অনুমতিক্রমে তাঁরা শ্বেতমর্মরের ছোট একটি টুকরোয় ‘সৌন্দর্যবর্ধনে অমুক কোম্পানি’ কথাটি লিখে রাখতে পারবেন। শপিং মলের মতো গোরস্থানে কত মানুষের আসা-যাওয়া। এই অভিনব বিজ্ঞাপনটি তাঁর কোম্পানির জন্য লাভজনকই হবে। আমার দীর্ঘজীবন কামনা করে সমঝদার সেলস মহিলাটি বিদায় জানালেন।
মধ্যযুগীয় সমাধিসৌধগুলো স্থাপত্যশিল্পের অনুপম নিদর্শন। বাংলাদেশের অনেক কবরই আমাদের রক্তস্নাত ইতিহাসের সাক্ষী। আর আমার মতো একজন সাধারণ মরণশীলের তথাকথিত ‘স্থায়ী’ কবর একটি অর্থহীন পার্থিব বাসনা। সবই যে অস্থায়ী, সে তৈমুরের সমাধিসৌধই হোক অথবা আমার কবর। তবে সবার জন্যই রয়েছে মহান কোরআনের সূরা কাফ্-এর (৫০: ৪৩) চিরন্তন অভয়বাণী, ‘আমিই জীবন দান করি, মৃত্যু ঘটাই এবং সকলের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে।’
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.