বাজেট-উন্নয়ন বাজেটের পুরোটাই ঘাটতি! by তোফাজ্জল হোসেন

বাজেটে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) জন্য তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। পিপিপির মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। আসলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা,


বিনিয়োগকারীর অর্থের পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে না পারলে আগের মতো পিপিপির বাস্তবায়ন বা সুফল পাওয়া যাবে না


২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাত মিলে সরকারের প্রয়োজন ১,৬৩,৫৯৮ কোটি টাকা। যা পাওয়া যাবে রাজস্ব বোর্ড থেকে ৫৬.২ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন থেকে ১৩.৬ শতাংশ, রাজস্ব বোর্ডবহির্ভূত কর ২.৪ শতাংশ, বৈদেশিক ঋণ ৮.০ শতাংশ ও বৈদেশিক অনুদান ৩.০ শতাংশ। আয় ছাড়া ব্যয়ের ঘাটতি ৪৫,২০৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫.০ শতাংশ। এই ঘাটতি মোকাবেলাই সরকারের বাজেট বাস্তবায়নের মূল চ্যালেঞ্জ অর্থাৎ উন্নয়ন বাজেটের পুরোটাই ঘাটতি বাজেট। ঘাটতি মোকাবেলায় সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ২৭,২০৮ কোটি এবং বৈদেশিক খাত বা সূত্র থেকে ১৭,৯৯৬ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থের ১৮,৯৫৭ কোটি টাকা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সংগৃহীত হবে, যা জিডিপির ২.১ শতাংশ। দেশে বর্তমানে ব্যাংক ব্যবস্থায় তারল্য সংকট বিদ্যমান। এমনিতেই ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ১৪-১৫ শতাংশ সুদে ডিপোজিট সংগ্রহ করছে। স্বাভাবিকভাবেই ঋণ বিতরণে সুদের হার ১৮-২০ শতাংশ। সুদের হার বাড়ায় প্রাইভেট সেক্টরের উদ্যোক্তারা নতুন শিল্প স্থাপনে উৎসাহ হারাবে, অন্যদিকে তারল্য সংকটের কারণে শিল্পঋণ কমে যাবে। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না, শিল্পে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত পণ্যের দামও বাড়বে। এতে সরকারের ২০১১-১২ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রত্যাশা ব্যাহত হবে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে। অন্যদিকে বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্তির আশাবাদ ১৭,৯৯৬ কোটি টাকা। বিগত বছরগুলোর বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকার কোনো বছরই এ খাতে সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। বরং বৈদেশিক ঋণের নানা শর্তের বেড়াজালে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি স্লথ হয়ে যায়। এ ছাড়া বৈদেশিক ঋণ বাজেট ঘাটতি মোকাবেলায় কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করবে তা সরকারের সুনাম ও স্থিতিশীলতার ওপরও নির্ভরশীল।
কৃষি খাতে বরাদ্দ ও ভর্তুকি বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১১,৯১১ কোটি টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরের চেয়ে ১২৮১ কোটি টাকা কম। মূলত আইএমএফের চাপেই ভর্তুকিতে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রায় ৬ কোটি লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। বরাদ্দ ও ভর্তুকি কমার কারণে ২০১৩ সাল নাগাদ সরকার ঘোষিত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যে মন্দা-উত্তর বিশ্ববাজারে খাদ্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশীয় বাজারেও মূল্যবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে। আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত ঝুঁকি তো আছেই। খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের উচিত ছিল কৃষি খাতের বরাদ্দ ও ভর্তুকি বাড়ানো।
প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৮,৩১৯ কোটি টাকা বা ৫.১ শতাংশ, যা ২০১০-১১ অর্থবছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চলমান সংকট নিরসনে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০১৩ সাল নাগাদ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সাত হাজার মেগাওয়াট। প্রয়োজন ৮০ হাজার কোটি টাকা। বছরওয়ারি ২৭ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও বরাদ্দ পরস্পর বিপরীতমুখী। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে বিনিয়োগ নিম্নতম পর্যায়ে নেমে এসেছে। ব্যাংক ঋণে প্রতিষ্ঠিত অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে পারছে না। এ ছাড়া বাজেটে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা নেই। এ খাতের নাজুক পরিস্থিতি উন্নয়নে এডিপির বাস্তবায়ন, গ্যাসকূপের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো, সাগরের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন, জাতীয় কয়লানীতি চূড়ান্তকরণ জরুরি।
বাজেটের আলোচিত বিষয় কালো বা অপ্রদর্শিত আয়। আসলে দেশ শাসনে সৎ, দক্ষ ও দায়িত্বশীল প্রশাসন ব্যবস্থা থাকলে কালো টাকা থাকার কথা নয়। সুশীল সমাজের প্রতিবাদ সত্ত্বেও নানা চাপে সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখে। এ বছর সরকার বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ ব্যয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা না থাকায় অর্থ ব্যয়ে বিভ্রান্তির আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারকে সাবধানী হতে হবে।
বিগত দুই বছরে আমাদের পুঁজিবাজার শক্তিশালী অবস্থানে পেঁৗছেছে। আস্থার সংকটের কারণে বর্তমানে বাজার স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আবার উৎপাদনমুখী শিল্প স্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগযোগ্য মূলধনের অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় অর্থমন্ত্রীর ভাষায় বলব, মন্দের ভালো হিসেবে কালো টাকা দীর্ঘমেয়াদে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে শিল্প স্থাপন ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়া উচিত।
২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেটে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) জন্য তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। পিপিপির মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। আসলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বিনিয়োগকারীর অর্থের পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে না পারলে আগের মতো পিপিপির বাস্তবায়ন বা সুফল পাওয়া যাবে না।
বাজেটে খাতওয়ারি আলোচনায় নানা মতভেদ, মতপার্থক্য রয়েছে। বরাদ্দের ক্ষেত্রেও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা লক্ষণীয়। গরিব ও সাধারণ মানুষের একরকম বাজেট চাই, ব্যবসায়ীর অন্যরকম, কৃষিজীবীর আরেক রকম। রয়েছে নানা আকাঙ্ক্ষা, নানা প্রত্যাশা। চাই উন্নয়ন, কমসংস্থান, নিরাপত্তা, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ, সুখী-সমৃদ্ধিশালী সমাজ। সবকিছুই যেন বাজেটকে ঘিরে। এসব কারণেই বাজেটের গুরুত্ব। আলোচনায় বাজেটের যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উঠে এসেছে সেগুলো হলো, বাজেট বাস্তবায়ন, প্রবৃদ্ধি অর্জন, ঘাটতি মোকাবেলা, মূল্যস্ফীতি হ্রাস। পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা যা-ই থাকুক না কেন, আগামী দিনগুলোতে বাজেটের চ্যালেঞ্জগুলো বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করবে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা।

তোফাজ্জল হোসেন : চেয়ারম্যান ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড
 

No comments

Powered by Blogger.