লিঙ্গবৈষম্য ও ভাষা by ড. শিশির ভট্টাচার্য্য

ভাষা মানুষে মানুষে যোগাযোগের একটি মাধ্যম। প্রতিটি ভাষা বহুসংখ্যক সুবিন্যস্ত চিহ্নের সমষ্টি এবং সাধারণত প্রতিটি চিহ্নের তিনটি দিক থাকে : ১. দ্যোতক, ২. দ্যোতিত ও ৩. নির্দেশিত। 'ক-ল-ম' ধ্বনিক্রম বা লিপিক্রমটি একটি দ্যোতক; 'কলম' কথাটি শুনে বা পড়ে মনে যে ছবি ভেসে ওঠে তাকে বলা হয় 'দ্যোতিত' আর বাস্তবের প্লাস্টিক-ধাতুতে


তৈরি লিখনযন্ত্রটি হচ্ছে 'নির্দেশিত'। চিহ্নের দ্যোতক-দ্যোতিত-নির্দেশিত কালের প্রবাহে বদলায়। একসময় আরবি কৃতঋণ দ্যোতক 'কলম'-এর পরিবর্তে ব্যবহৃত হতো সংস্কৃত কৃতঋণ দ্যোতক 'লেখনী'। 'কলম' বলতে আজ থেকে শখানেক বছর আগে বাঙালির মনে যে ছবি ভেসে উঠত এখন সেই ছবি ভেসে ওঠার কথা নয়, কারণ শখানেক বছরে 'কলম'-এর নির্দেশিতের অনেক পরিবর্তন হয়েছে_বহু ব্যবহৃত ঝরনা কলম এখন প্রায় ইতিহাস এবং তার জায়গায় এসেছে বিভিন্ন ধরনের বলপয়েন্ট। সুতরাং নির্দেশিত বা বস্তুর পরিবর্তন হলেও চিহ্নের দ্যোতিত বদলে যেতে পারে। ব্যাকরণ ও শব্দকোষ_এই দুইয়ে মিলে ভাষা। ব্যাকরণের তিনটি উপাঙ্গ : রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব আর ধ্বনিতত্ত্ব। প্রথম দুটি উপাঙ্গে স্থির হয় কেমন করে শব্দ আর বাক্য গঠিত হবে। আর তৃতীয় উপাঙ্গে স্থির করা হয় কিভাবে সে শব্দ আর বাক্যগুলো উচ্চারিত হবে। প্রশ্ন হতে পারে_ভাষার ওপর সমাজের কোনো প্রভাব আছে কি না অর্থাৎ সমাজ বদলে গেলে ভাষার রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব, ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দকোষ সব বদলে যাবে কি না বা ভাষাকে বদলে দেওয়া গেলে সমাজ আপনা থেকেই বদলে যাবে কি না। ঊনবিংশ শতকে কয়েকজন ভাষাবিজ্ঞানী মনে করতেন, কোনো ভাষার ব্যাকরণ সেই ভাষাভাষী সমাজের মানুষের মানসিক বিকাশকে প্রতিফলিত করে। যেমন হুমবোল্ড (১৮৩৬) লিখেছিলেন, সংস্কৃত ও গ্রিক ভাষার ব্যাকরণে প্রাচীন ভারতীয় ও গ্রিক জনগোষ্ঠীর উন্নত মানসিক গঠন প্রতিফলিত হয়েছে। বিংশ শতকে স্যাপির (১৯২১) দাবি করেছেন, কোন ভাষার শব্দকোষ কেমন হবে তা সেই ভাষাভাষী সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। এস্কিমোদের ভাষায় বরফের অনেক প্রতিশব্দ আছে, কারণ তাদের জীবনে বরফের একটি বড় ভূমিকা আছে।
বিরল কিছু ভাষায় নারী ও পুরুষ, ধনী ও গরিব, উচ্চপদস্থ ও নিম্নপদস্থ লোকের জন্য ব্যাকরণের আলাদা নিয়ম থাকতে পারে কিন্তু বেশির ভাগ ভাষায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের ভাষার পার্থক্য হয় প্রধানত শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে। জাপানি ভাষায় এমন কিছু শব্দ বা শব্দক্রম আছে যা কোনো উচ্চপদস্থ কর্মচারীই শুধু ব্যবহার করতে পারেন। আবার অন্য কিছু শব্দ ও শব্দক্রম আছে যা শুধু অধস্তন কর্মচারীরাই ব্যবহার করে থাকেন। মধ্যযুগের জাপানি সমাজ খুবই 'ক্ষমতানুক্রমিক' (হায়ারার্কিক) ছিল অর্থাৎ উচ্চপদস্থ ও নিম্নপদস্থের মধ্যে সামাজিক অবস্থানের একটি পার্থক্য আছে বলে ধরে নেওয়া হতো এবং জাপানি সমাজের প্রত্যেক সদস্যকে এই ক্ষমতানুক্রম মেনে ভাষা ব্যবহার করতে হতো, যা এখনো অনেকটা বজায় আছে। এখানে আমরা লক্ষ করতে পারি, বিশেষ সামাজিক কাঠামো প্রতিফলিত হচ্ছে ভাষার দ্যোতক অংশে। নির্দেশিতের বিশেষ গঠনের কারণে বিশেষ দ্যোতিত ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু শব্দকোষ ও ব্যাকরণের ওপর সমাজব্যবস্থার প্রভাবের দাবি ভাষাবৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা সমর্থিত নয়। ফরাসি বিপ্লবের আগের ফ্রান্স আর বিপ্লব-পরবর্তী নেপোলিয়নের ফ্রান্সের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বিশাল পার্থক্য ছিল কিন্তু বিশেষজ্ঞরা লক্ষ করেছেন এ দুই সময়ের ফরাসি শব্দকোষ ও ব্যাকরণের মধ্যে খুব একটা তফাত ছিল না। জার-শাসিত রাশিয়া ও রুশ বিপ্লবের পরের সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যবহৃত রুশ ভাষার শব্দকোষ ও ব্যাকরণেও তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়নি। চিয়াং কাইশেক সরকারের সময়কার চীনা ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দকোষ মাও সে তুংয়ের যুগে এসে খুব একটা বদলেছে এমনটা বলা যাবে না। হ্যাঁ, নতুন কিছু শব্দ, যেমন ধরুন 'লাল ফৌজ', 'লাল চত্বর', 'কমরেড' ইত্যাদি রুশ বা চীনা শব্দকোষে স্থান পেয়েছিল বটে; কিন্তু কিছু শব্দের অন্তর্ভুক্তিতে শব্দকোষের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না। এটা ঠিক যে একাধিক ভাষার মধ্যে যোগাযোগ হলে এক ভাষা অন্য ভাষা থেকে শব্দঋণ গ্রহণ করে কিন্তু ব্যাকরণের ব্যাপারে ভাষা অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল। গত শতকে অনেকে মনে করতেন, যে ব্যক্তি বা সমাজ যত অনগ্রসর তার ভাষাও তত অনগ্রসর। এটি একটি বিশ্বাস মাত্র, কোনো বিজ্ঞানসম্মত ধারণা নয়। কোনো মানুষ তার ভাষা ঠিক ততটুকুই ব্যবহার করে, যতটুকু তার প্রয়োজন। বাংলা ভাষায় 'শুধু স্ত্রীর কথামতো চলতে গিয়ে ন্যায়-অন্যায় বিচার করে না যে পুরুষ' তাকে 'স্ত্রৈণ' বলা হয়। 'শুধু স্বামীর কথামতো চলে' এমন মহিলার বর্ণনা দিতে গিয়ে 'চাবি দেওয়া কলের পুতুল' আর 'দাই মহিলা' শব্দক্রম দুটি ব্যবহৃত হতে শুনেছি। জাপানি ভাষায় দুটি মাত্র গালি আছে; কা@ে@@@া (টোকিও) অঞ্চলের 'বাকা' আর কানসাই (ওসাকা) অঞ্চলের 'আহো'। এ দুটি গালির অর্থ 'বোকা'। কিন্তু অশ্লীল শব্দ না থাকার মানে এই নয় যে জাপানিরা একে অন্যকে অপমান করে না। অশ্লীল শব্দ ব্যবহার না করেও অপমান করার হাজার এক উপায় আছে যেকোনো ভাষায়। একটি উদাহরণ দিই : 'বাম চোখ টেরা', 'ডান চোখ টেরা', 'দুই চোখ টেরা'_এ তিনটি দ্যোতিত/নির্দেশিতের জন্য আলাদা একাধিক শব্দ আছে জাপানি ভাষায় এবং এ শব্দগুলো অপমান করার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত পুরুষরা শার্ট-প্যান্ট পরত, মেয়েরা পরত শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ। এখন মেয়েরা শার্ট-প্যান্ট পরছে বলে এই পোশাকবাচক শব্দগুলোর নারী সংস্করণ ('শার্টি' বা 'প্যান্টি') বের করতে হবে? যেকোনো ভাষার শব্দকোষে কিছু শব্দ থাকে 'চিহ্নিত' (মার্কড) আর কিছু শব্দ থাকে 'অচিহ্নিত' (আনমার্কড)। বাংলায় 'গরু' শব্দটি অচিহ্নিত, 'বলদ' ও 'গাভী' শব্দ দুটি চিহ্নিত। একইভাবে 'মহিষ' অচিহ্নিত, 'মাদাম' চিহ্নিত। 'গরু' বলতে শুধু 'পুরুষ গরু' বোঝায় না, স্ত্রী ও পুরুষ এ উভয় জাতের গরুই বোঝায়। 'গরু', 'মানব' ইত্যাদি মূলত (জাতিবাচক) উভয় লিঙ্গ শব্দ। 'মানবসভ্যতা' বলতে মানবীদের বাদ দেওয়া হয় না। তবে বিভিন্ন ভাষার ব্যাকরণ বিভিন্নভাবে শব্দকে চিহ্নিত করে। কিছু ভাষায় স্ত্রী-দ্যোতক শব্দগুলো চিহ্নিত হয়ে থাকে আবার অন্য কিছু ভাষায় পুরুষ-দ্যোতক শব্দগুলো চিহ্নিত হয়। এমন একটা সময় ছিল যখন 'রাষ্ট্রপতি', 'শিল্পপতি' ইত্যাদি শব্দ চিহ্নিত ছিল। এ শব্দগুলোয় নির্দেশিত হতেন শুধুই একজন পুরুষ। এখন সমাজের পরিবর্তনের ফলে শব্দগুলোর নির্দেশিতের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে এবং এখন এসব শব্দের নির্দেশিত একজন নারীও হতে পারেন (যেমন_ভারতের প্রতিভা পাতিল)। এই শব্দগুলো এখন অচিহ্নিত হয়ে গেছে বা উভয় লিঙ্গে পরিণত হয়েছে। ইংরেজিতে 'নার্স' এখনই উভয় লিঙ্গ শব্দ হয়ে গেছে অর্থের দিক থেকে।
ব্যাকরণে স্ত্রীবাচক শব্দ তৈরি করার নিয়ম থাকলেই যে সে নিয়ম ভাষাভাষীদের পছন্দ হবে এমন কোনো কথা নেই। 'রাষ্ট্রপত্নী' বা 'শিল্পপত্নী' ব্যাকরণসম্মত শব্দ, কিন্তু গ্রহণযোগ্য শব্দ নয়। 'নেতা' শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ 'নেত্রী' বা 'জেলে' শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ 'জেলেনি' নিয়ে কেউ আপত্তি তোলেনি, কিন্তু 'ডাক্তার' শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ 'ডাক্তারনী' চালু করা যায়নি আর 'কবি' শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ 'কবিনী' চালু হওয়ার প্রশ্নই আসে না। 'মহিলা পুলিশ,' 'মহিলা শ্রমিক' চালু হয়ে গেছে কিন্তু 'মহিলা ডাক্তার' বা 'মহিলা কবি' বাংলাভাষীরা গ্রহণ করেনি। এখানে আমরা লক্ষ করতে পারি, স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ গঠন-সংক্রান্ত বাংলা ব্যাকরণের দুই দুইটি নিয়ম অগ্রাহ্য হয়েছে এবং অগত্যা 'কবি' বা 'ডাক্তার' উভয় লিঙ্গ শব্দ হিসেবে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। একই ব্যাপার ফরাসি ভাষায়ও ঘটেছে। ফরাসি ভাষায় নারীবাদী কয়েকজন লেখক বেশ কিছু পুংলিঙ্গ শব্দ যেমন_চৎবংরফবহঃ, ঢ়ৎড়ভবংংড়ৎ ইত্যাদিকে স্ত্রীলিঙ্গে পরিণত করে চৎবংরফবহঃ, ঢ়ৎড়ভবংংড়ৎ লিখতেন। শব্দগুলো নিয়ে পুরুষরা খুব একটা আপত্তিও করেনি এবং বেশ কিছুদিন চলেছিল। কিন্তু ইদানীং সব লেখকই আবার উভয় লিঙ্গের মাহাত্ম্য ও নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে চৎবংরফবহঃ, ঢ়ৎড়ভবংংড়ৎ ব্যবহার করা শুরু করেছেন। কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী সচেতনভাবে তাদের ভাষাকে পরিবর্তন করতে পারে না। ভাষার নিয়মগুলো পরিকল্পনামাফিক তৈরি। এ ছাড়া শুধু ভাষার পরিবর্তন করে সমাজের পরিবর্তন করা যাবে না। নারীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় এমন একটি অশ্লীল শব্দও যদি না থাকে বাংলা শব্দকোষে তাহলেই কি বাঙালি সমাজে নারীর সম্মান বেড়ে যাবে? সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন হলেই নারীবাচক অশ্লীল শব্দ অব্যবহৃত হতে হতে ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে পারে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, নারী বা পুরুষবাচক অশ্লীল শব্দ না থাকাও শব্দকোষের একটি দুর্বলতা। ভাষা নিজে থেকে লিঙ্গবৈষম্য সৃষ্টি করে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। অবশ্য সমাজে লিঙ্গবৈষম্য থাকলে ভাষায় তার প্রতিফলন হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তবে সামাজিক লিঙ্গবৈষম্যের কারণে যদি ভাষিক লিঙ্গবৈষম্যের সৃষ্টি হয় তবে তা দূর করার মতো ব্যবস্থা প্রতিটি ভাষাতেই রয়েছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.