চারুশিল্প-আশা-জাগানিয়া মঙ্গলবারতা by জাফরিন গুলশান

চারুশিল্পের প্রসারে অধিকমাত্রায় প্রদর্শনী হওয়া প্রয়োজন। শিল্পীর শিল্পচর্চা এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন শিল্পের অর্থনৈতিক মূল্য বিচারের সঠিক নীতি। বিশ্বব্যাপী শিল্পজগতের প্রাতিষ্ঠানিকতার বিনির্মাণ চলছে এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।


বিত্তবান লোকেরা চারুশিল্পকে স্বাগত জানাচ্ছেন শিল্পরস ও শিল্পমূল্যমান নির্ণয়ে তাঁদের বিবিধ কর্মকাণ্ড দিয়ে; যেভাবে গ্যালারি ‘অ্যাথেনা’র যাত্রা শুরু। ৯ জুন পথচলা শুরু করেছে গ্যালারিটি। দেশের স্বনামধন্য বিভিন্ন প্রজন্মের ৬৭ জন শিল্পীর শিল্পকর্ম পাঁচ হাজার বর্গফুট আয়তনের প্রদর্শনীকক্ষে মাসব্যাপী প্রদর্শিত হবে।
অ্যাথেনা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের চেয়ারম্যান নীলু মোর্শেদ দীর্ঘদিন ধরে শিল্পকর্ম সংগ্রহ করছেন। সেই ধারাবাহিকতার আরেকটি পদক্ষেপ এই গ্যালারির উদ্বোধন।
আমাদের অগ্রজতম শিল্পীদের অন্যতম কাইয়ুম চৌধুরীর ‘লিবার্টি’ শিরোনামের জলরং ছবিটি অলংকরণ (ইলাস্ট্রেশন) ঢঙে করা। সবুজ, নীল, লাল, হলুদের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের অবয়ব। ছবিটি নির্মাণের ভঙ্গিতেও স্বাধীনতার আবহ। টেপেস্ট্রি-মাধ্যমের শিল্পচর্চা এখন প্রায় বিলুপ্ত। কিছু পরিমাণে উৎপন্ন হয় বাণিজ্যিকভাবে পণ্য নির্মাণে। শিল্পী রশীদ চৌধুরীর ‘কম্পোজিশন ১২’ শীর্ষক শিল্পকর্মটি তাই দুর্মূল্য। ১৯৮০ সালে করা এই টেপেস্ট্রির সুতা বুননের দক্ষতা, নান্দনিক রং ও কর্মের একত্রীকরণ বেশ শক্তিশালী শিল্প-অধ্যায়কে স্মরণে আনে।
শিল্পী মুর্তজা বশীরের ‘দি উইং # ১২৫’ সিরিজের শিল্পকর্মটি বাস্তবতার সরলীকরণে বিমূর্ত ফলাফল। একটি প্রজাপতির পাখার রং, ফর্ম আর সদা কম্পমান ডানার প্রাণের স্পন্দনকে ধরেছেন শিল্পী।
শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর, শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, শিল্পী আবু তাহের প্রমুখ অগ্রজ শিল্পীর মূল্যবান শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ রয়েছে পরবর্তী সময়ের শিল্পী রফিকুন্নবী, শিল্পী মনিরুল ইসলাম, শিল্পী মাহমুদুল হক, শিল্পী সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, শিল্পী কালিদাস কর্মকার, শিল্পী মতলুব আলী, শিল্পী আবুল বারক আলভী, শিল্পী শহীদ কবির, শিল্পী শাহাবুদ্দীন প্রমুখ প্রতিভাবানের সম্মিলনে।
প্রদর্শনীতে শিল্পীদের বিভিন্ন সময়ের আঁকা ছবিগুলো একভাবে শিল্পীর বিবর্তন ইতিহাসকে উপস্থাপন করে। যদিও বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর একটি; এখানে নারীর প্রতি পুুরুষতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা অনেক, কিন্তু শিল্পী ফরিদা জামান, শিল্পী নাইমা হক, শিল্পী কুণ্ডু প্লামন্ডন, শিল্পী কনকচাঁপা চাকমা, শিল্পী আইভি জামান, শিল্পী রোকেয়া সুলতানা, শিল্পী নাসরীন বেগমদের শিল্পীচর্চার সংগ্রাম এবং উন্নত শিল্পগুণ সৃষ্টি আমাদের সামাজিক অগ্রগতির দৃপ্ত প্রকাশ।
সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার চারুশিল্প গত কয়েক দশকের মধ্যে এখন বেশ ভালো অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। নব্যসৃষ্ট বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ ও শিল্পের প্রতি তাঁদের নান্দনিক আগ্রহ এবং ব্যবসায়িক প্রণোদনা এ দেশের শিল্পচর্চাকে গতি প্রদান করতে শুরু করেছে। সমসাময়িক বিশ্বের শিল্প আন্দোলনে আমাদের শিল্পীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমাদের সীমাবদ্ধতা হলো সবকিছুর কাজি হিসেবে ঢাকাকে তৈরি করা। ফলে গ্যালারিগুলোও তেমন ভূমিকাতেই অবতীর্ণ। প্রগতি সরণি, মধ্যবাড্ডায় অবস্থিত এই গ্যালারি তাঁদের কর্মকাণ্ডকে বিশ্বের দরবারে প্রচার করার স্বপ্ন দেখছে। আরও ফলপ্রসূ হতো যদি দেশের বিভিন্ন জেলায় বিস্তৃতি ঘটানোর মতো বিশেষ চারুশিল্পের উদ্যোগ তারা নিতে পারে।
গ্যালারি অ্যাথেনাকে আরও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল শিল্পকর্মের প্রদর্শন প্রক্রিয়ার বিষয়ে। এখানে একধরনের কিউরেটরিয়াল পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারত। নামজাদা চিত্রশিল্পীদের ভিড়ে তিনজন ভাস্করের উপস্থিতি প্রদর্শনীকে উন্নত মাত্রা দিয়েছে, যদিও শিল্পী হামিদুজ্জামান খান কোনো ভাস্কর্য প্রদর্শন করেননি। তরুণ ভাস্কর মাহমুদুল হাসান ‘ইয়োথফুল অফেন্ডার’ এবং ভাস্কর তেজস হালদার জসের ‘মেসেঞ্জারস’ শিরোনামের ভাস্কর্যগুলো প্রতিশ্রুতিশীলভাবেই সৃজনশীল।
আরও অংশ নিয়েছেন সমসাময়িক সফল শিল্পী মোহাম্মদ ইউনুস, শিল্পী জামাল আহমেদ, শিল্পী নাসিম আহমেদ নাদভী, শিল্পী মোস্তাফিজুল হক, শিল্পী রণজিৎ দাস, শিল্পী রেজাউননবী, শিল্পী ঢালী আল মামুন, শিল্পী আহমেদ শামসুদ্দোহা, শিল্পী খালিদ মাহমুদ মিঠু, শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য, শিল্পী ফারেহা জেবা, শিল্পী দিলারা বেগম জলি, সমসাময়িক কাঠখোদাই শিল্পী আনিসুজ্জামান আনিস, শিল্পী শেখ আফজাল, শিল্পী মাহবুবুর রহমান, শিল্পী রশিদ আমিন, শিল্পী মোহাম্মদ ইকবাল, শিল্পী শহিদুল হক জুইস, শিল্পী গোলাম ফারুক বেবুল, শিল্পী আহমেদ শামসুদ্দোহা, শিল্পী সাঈদ হাসান মাহমুদ, শিল্পী আতিয়া ইসলাম অ্যানী, শিল্পী আহমেদ নাজির, শিল্পী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, শিল্পী দেবাশিষ পাল, শিল্পী তৈয়বা বেগম লিপি, শিল্পী দুলাল গাইন, শিল্পী মো. ওয়াহিদুজ্জামান, শিল্পী আবদুস সাত্তার তৌফিক, শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী প্রমুখ।
অনেক বেশি করপোরেট আঙ্গিকের গ্যালারি অ্যাথেনার শুভ যাত্রা, শিল্পীদের শিল্প প্রদর্শন ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল আলোর দ্বীপ জ্বেলে গেলেই এর সার্থকতার মানদণ্ড বিচার্য হবে।

No comments

Powered by Blogger.