বাকস্বাধীনতা-গনমাধ্যম যখন নিন্দার তোপে by রোবায়েত ফেরদৌস

পাঠক, লক্ষ করুন সংবাদটি: ‘জাতীয় সংসদে গতকাল মঙ্গলবার অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে দুই মন্ত্রী এবং মহাজোটের পাঁচ সাংসদ সংবাদপত্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন।...শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, যাঁরা সাংসদদের সমালোচনা করেন, তাঁরা দেশের গণতন্ত্র নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।


স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, সংসদ ও সাংসদদের অবমাননা ও হেয় করা সাম্প্রতিক সময়ে ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।’ (প্রথম আলো ২২ সেপ্টেম্বর)
আসলেই কি তাই? সাংবাদিকতার বইতে পড়েছি, ‘পৃথিবীর সব সরকারই কমবেশি মিথ্যা বলে এবং পৃথিবীর সব সরকারই জনগণের কাছ থেকে কিছু না কিছু লুকোতে চায়, আর সাংবাদিকতার কাজ হচ্ছে সেই মিথ্যা আর লুকোনো বিষয়কে বের করে জনসমক্ষে প্রকাশ করা।’ গণমাধ্যমের কাজই সরকারের সমালোচনা করা, সরকার আর প্রশাসনের ভুলত্রুটি খুঁজে বের করা। তাই পেশাগতভাবেই সাংবাদিকদের সন্দেহপ্রবণ হতে হয়, হতে হয় ছিদ্রান্বেষী! একটি দেশের গণতন্ত্র মাপার অন্যতম গজকাঠি হচ্ছে সে দেশের ‘ফ্রিডম অব দ্য প্রেস’-এর চর্চা কতটা হয় তা দিয়ে। গণতন্ত্রের সমার্থক শব্দ পরমতসহিষ্ণুতা, টলারেন্স। যেমনটি ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশ করতে দেওয়ার জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি।’ বিনয়ের সঙ্গে জানতে ইচ্ছে করে, গণতন্ত্রচর্চার এই ভলতেয়ারীয় দর্শন থেকে সরকার কত হাজার মাইল দূরে অবস্থান করছে?
গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের কিছু পদক্ষেপ দেখে উপরিউক্ত কথাগুলো বলার প্রয়াশ পেয়েছি। ভুল বোঝার অবকাশ নেই, বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি থেকে রেহাই পেতে, তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক-সামরিক কোয়ালিশন সরকারের শ্বাস-বন্ধ-করা গুমোট অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মানুষ ২০০৮ সালে ভোটবিপ্লব ঘটায় এবং বিপুল সমর্থন দিয়ে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় হাজির করে। প্রতীতি ছিল, দেশে মুক্তচিন্তার পরিবেশটি তার কাঙ্ক্ষিত পরিসর খুঁজে পাবে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় সাংবাদিকদের ওপর যে হামলা-মামলা-হত্যা-নির্যাতন হয়েছে তার অবসান হবে, তত্ত্বাবধায়ক-সামরিক কোয়ালিশন সরকারের জরুরি অবস্থার সময় সংবাদপত্র ও টিভি তথা মত প্রকাশ ও প্রেসের স্বাধীনতাকে যেভাবে কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল, তা থেকে জাতির উত্তরণ ঘটবে।
কিন্তু সংসদে ওই দিনের আলোচনায় মাননীয় সাংসদেরা পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া এবং সংসদে সম্পাদকদের তলব করারও দাবি জানিয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অসত্য ও ভিত্তিহীন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষুব্ধ হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধরা প্রতিবাদ পাঠালে সংশ্লিষ্ট পত্রিকা তা ছাপতে বাধ্য। এ ছাড়া তাঁরা প্রতিকারের জন্য প্রেস কাউন্সিল বা আদালতেরও আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু সেসব না করে আইনপ্রণেতারা জাতীয় সংসদে যে ঢালাও অভিযোগ এনেছেন, তা সংবাদমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের প্রতি হুমকি ছাড়া কিছু নয়। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা পরস্পরের পরিপূরক, বিপরীতমুখী নয়। টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কোনো অবস্থায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না। আবার সংবাদমাধ্যমকেও তার বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা বজায় রাখতে হবে। আমরা মনে করি, সংবাদমাধ্যমের সমালোচনাকে বৈরী হিসেবে দেখা ঠিক নয়। গণতন্ত্রের বিকাশে ভিন্নমত পোষণের পূর্ণ সুযোগ থাকতে হবে।
বুঝতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া এই সরকার মাত্র ১৯ মাসে কেন এতটা ভীত হয়ে পড়ছে? ভেবে পাচ্ছি না, সরকার কেন এতটা শঙ্কিত? চারটি কাগজ/তিনটি চ্যানেল সরকারের সমালোচনা করলে কী এমন ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়? প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা সব সময়ই আমাদের আশাবাদী করে তোলে, কিন্তু এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত তাঁকে কারা দিচ্ছেন? যাঁরা এসব পরামর্শ দিচ্ছেন, আমি মনে করি, আর যা-ই হোক, কখনোই তাঁরা এ সরকারের মিত্র হতে পারেন না!
১৯৭১—২০১০, দীর্ঘ ৩৯ বছর কেটে গেছে। আমরা তো ভেবেছিলাম, অতীতের ভূত থেকে দূরে সরে এসে এবং পেছনের ভুলগুলো স্বীকার করে নিয়ে বাংলাদেশ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক চর্চায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোনোর চেষ্টা করছে। কিন্তু হায়! এ তো দেখি ভুল ভাবনা। আমরা কি তবে আবারও ফেলে আসা পুরোনো পথে হাঁটছি? জনগণের এত বিশাল ম্যান্ডেট নিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, ভাবতে অবাক লাগে, এ রকম অগণতান্ত্রিক আচরণ তাঁরা করছেন কীভাবে? এ তো নিতান্তই স্বৈর মানসিকতা, নইলে জাতীয় সংসদে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে কেন এই নিন্দার তোপ? নইলে এক মাসের ব্যবধানে ইলেকট্রনিক মাধ্যম চ্যানেল ওয়ান, প্রিন্ট গণমাধ্যম আমার দেশ এবং নতুন গণমাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশসহ বাকি বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় নেটওয়ার্ক ‘ফেসবুক’ বন্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত সরকার নেয় কীভাবে? যে বড় আশায় আমরা এ সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলাম, আমরা চাইব না ভবিষ্যতে অহেতুক সংসদে গণমাধ্যমের গুষ্টি উদ্ধার বা গণমাধ্যম বন্ধের মতো অগণতান্ত্রিক আচরণের মধ্য দিয়ে সরকার আমাদের সে আশার রুটিতে পিঁপড়ে তুলে দেয়।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর তিনদলীয় ঐকজোটের সম্মিলিত দাবির অন্যতম ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং সেই দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকার ‘প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন অ্যাক্ট ৭৩’ সংশোধন করে এমন ব্যবস্থা করে, যাতে কোনো সরকার সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করতে না পারে। পরবর্তী সব সরকার সাহাবুদ্দীন আহমদের এই সংশোধিত ধারার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। সাংবাদিকতার শিক্ষক হিসেবে, যদিও আমি নিজেকে একাডেমিক জার্নালিস্ট বলতেই বেশি পছন্দ করি, আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম যে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জায়গাটি ধীরে ধীরে শক্ত পাটাতনের ওপর দাঁড়াচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের যে সাম্প্রদায়িক সরকার দেশে ছিল, তার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের বিজয়কে আমরা স্বাগত জানিয়েছিলাম; কিন্তু সরকারের ভূমিকায় আমরা আশাহত হয়েছি। সরকার কি সব সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও মানুষের তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমকে বিটিভি আর বাংলাদেশ বেতারের মতো বানাতে চায়, যারা সারাক্ষণ সরকারের বশংবদ হয়ে সত্য-মিথ্যার মিশেলে কেবল সরকারের শংসাবচন প্রচার/প্রকাশ করে যাবে? কারণ, সমালোচনা করলেই তো সংসদে নিন্দাবাদ, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ, টেলিভিশন বন্ধ এবং ফেসবুক অবরুদ্ধ। এমনিতেই সাংবাদিকতা পেশাটি চ্যালেঞ্জিং, বেতন-ভাতা আর কাজের পরিবেশ নিয়েও সমস্যা আছে, তার ওপর গণমাধ্যমকে তুলোধোনা বা বন্ধের মতো পদক্ষেপ, নতুনদের মধ্যে এ পেশায় ঢুকতে দ্বিধান্বিত করে তুলবে। সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করা আমি মনে করি আমার ধর্ম। চ্যানেল ওয়ান বন্ধে আমি ও আমার সহকর্মীরা তাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে এর প্রতিবাদ করেছি, প্রতিবাদ করেছি ফেসবুক বন্ধের, আমার দেশ পত্রিকা বন্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সমাবেশ করেছি। সমাবেশ করেছি বাংলাদেশে যাঁরা মুক্তবুদ্ধিচর্চার কথা বলেন, যাঁরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, অবাধ তথ্যপ্রবাহে যাঁদের অবিচল আস্থা, তাঁরা বিবেকের টানে হলেও এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন—এই আশায়। পরে অবশ্য আদালতের নির্দেশে আমার দেশ-এর প্রকাশনা পুনরায় শুরু হয়; আপিল বিভাগের রায়ে বোঝা যায় সরকারের ওই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। দিন কয়েক পর ফেসবুক খুলে দেওয়া হয়। চ্যানেল ওয়ানের সিদ্ধান্ত এখনো ঝুলে আছে।
মনে রাখা দরকার, প্রেসের স্বাধীনতা মানে হাত-পা খুলে যা খুশি রিপোর্ট করা নয়, প্রকাশিত রিপোর্টকে অবশ্যই সত্য, যথার্থ আর পক্ষপাতহীন হতে হবে। সততা, বস্তুনিষ্ঠতা আর নিরপেক্ষতা হচ্ছে সাংবাদিকতার মৌল তিন নীতি—যার ওপর দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার চর্চাটি হয়ে থাকে। এ জন্যই বলা হয় ‘ফ্রিডম ইজ নাথিং উইদাউট রেসপনসিবিলিটি’। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার পথে আমাদের হয়তো আরও অনেক দূর যেতে হবে। আমরা প্রেসের শতভাগ স্বাধীনতার কথা বলছি, তবে প্রেসের দায়িত্বশীলতার বিষয়টি সব সময় মাথায় জারি রাখছি। তবে ভুলে গেলে ভুল হবে যে প্রেসের এই স্বাধীনতা কেউ কাউকে দেয় না, স্বাধীনতা আদায় করে নিতে হয়। ক্ষমতাবানেরা তাদের সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে স্বাধীন সাংবাদিকতা পছন্দ করে না। এ জন্য কী করতে হবে? লড়তে হবে; এ লড়াই কেবল সংবাদপত্রের জন্য নয়, এ লড়াই গণতন্ত্রের জন্য, এ লড়াই উন্নয়নের জন্য, দেশটাকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য। বিদ্যুৎ নেই, সিএনজি স্টেশন বন্ধ, যানজট দূর হচ্ছে না, স্কুল-কলেজ বন্ধ—না, আমরা এ রকম বন্ধের সংস্কৃতি চাই না, খোলা আর মুক্ত সংস্কৃতি চাই। আমরা প্রশ্ন আর সমালোচনাহীন মৃত সমাজ চাই না, চাই বিতর্কময় জীবন্ত সমাজ। আমরা চাই সব কটা জানালা খোলা থাকুক—এতে কিছু ধুলোবালু আসবে ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাস করুন, সবচেয়ে বেশি আসবে আলো!
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
robaet.ferdous@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.