বাজেট বিশ্লেষণ-সরকারের ব্যাংকঋণ ও বিনিয়োগের ঝুঁকি by ফারুক মঈনউদ্দীন

প্রতিবছরের বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে এবং অব্যবহিত পর বিভিন্ন মহল এবং মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীরা বাজেটের যে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, সেসব উৎসাহী পাঠকের বোধগম্য হলেও বহু বিষয়ের তাৎপর্য সাধারণ মানুষের অনেকের কাছেই স্বচ্ছ হয় না।


তার ওপর রাজনৈতিকভাবে পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে দেশের সাধারণ মানুষ আরও বেশি সংশয়ী হয়ে পড়ে। কারণ, তারা বুঝতে পারে না বাজেটের প্রকৃত তাৎপর্য এবং গুরুত্ব কী। প্রতিবছর দেখা যায়, সরকার ও বিরোধী দল বাজেট ঘোষণার আগে থেকেই বাজেটের পক্ষে এবং বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বসে থাকে, যা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিরাচরিত নিয়ম। তবে এবারের বাজেটের আকার বিশাল হলেও প্রধান বিরোধী দল তা চিরায়ত ভাষায় সমালোচনা করেনি। বলা হয়েছে যে এটা জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে না। এমনকি এটা যে একটি উচ্চাভিলাষী বাজেট, এমন কথাও বলা হয়নি। বলার কথাও নয়, আজকালের যুগে এক লাখ ৯২ হাজার কোটি এমন আর কী টাকা! দেশের জিডিপি, উচ্চ-উচ্চবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার মান ও ব্যয় এবং তাদের দেশি-বিদেশি যোগাযোগে বিত্তের পরিমাণ বিবেচনায় এই পরিমাণ টাকা হয়তো খুব বেশি নয়। তবে এবারের বাজেট সম্পর্কে সবারই মিলিত সংশয় এর বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা নিয়ে। কারণ, প্রতিবছর বাজেটের আগে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশার জন্ম নেয়, সেটা পূরণ করা সম্ভব হয়নি কখনো। প্রতিবছর সাধারণ ছা-পোষা মানুষ ভাবেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমবে, ব্যবসায়ীরা ভাবেন কর বা শুল্ক কমবে, চাকরিজীবীরা ভাবেন করমুক্ত আয়ের সীমানা বাড়বে, এমনকি মজুদদারেরাও আশা করেন তাঁদের পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়বে। এ রকম বিভিন্ন স্তরের মানুষের নিজস্ব স্বপ্ন থাকে বাজেট নিয়ে।
আমরা জানি, বাজেট অর্থ একটা নির্দিষ্ট সময়সীমায় আয়-ব্যয়ের হিসাব। একটি দেশের বা সরকারের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব হচ্ছে জাতীয় বাজেট। এর সঙ্গে একটি পরিবারের বাজেটের কোনোই পার্থক্য নেই, কেবল আয়তন ছাড়া। একটি পরিবারের বাজেট বরাদ্দ যদি হয় এক লাখ ৯২ হাজার টাকা এবং আয় হয় এক লাখ ৪০ হাজার টাকা, তা হলে পরিবারটির ঘাটতি হয় ৫২ হাজার টাকা। আমাদের এবারের রাষ্ট্রীয় বাজেটেও ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা (এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা), আর রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা (এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা)। তার মানে আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিবারটির ঘাটতিও ৫২ হাজার কোটি টাকা। লক্ষণীয়, এখানে পরিবার এবং রাষ্ট্রের বাজেটের অঙ্কের মধ্যে পার্থক্য শুধু একটি শব্দ, ‘কোটি’।
পরিবারটি কিংবা আমাদের রাষ্ট্রের এই আয়-ব্যয়ের ঘাটতি থাকলেও তা মেটানো সম্ভব, যদি আমাদের বা পরিবারকে কেউ সাহায্য করে কিংবা আমরা বা সেই পরিবারটি ঋণ গ্রহণ করে। আমাদের রাষ্ট্র নামক পরিবারের এই ঘাটতি মেটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে দুটি সূত্র থেকে—বৈদেশিক সাহায্য ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে রাজস্ব খাত। আমদানি ও আবগারি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর, আয়কর—এ রকম নানা ধরনের শুল্ক ও কর হচ্ছে সরকারি আয়ের মূল উৎস। এই রাজস্ব দিয়ে সরকারি ব্যয় বরাদ্দের সম্পূর্ণ অংশ মেটানো সম্ভব হয় না বলেই সরকারকে সাহায্য নিতে হয় বিদেশ থেকে কিংবা ঋণ নিতে হয় ব্যাংক ও জনসাধারণের কাছ থেকে। এবারের বাজেটে অনুমিত ব্যয়ের চেয়ে রাজস্ব আয়ের ৫২ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি মেটানো হবে বৈদেশিক সূত্র তথা ঋণ ও সাহায্যের ১৮ হাজার কোটি টাকা, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে।
বাজেটের ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারকে যে ঋণ গ্রহণ করতে হয়, তার রয়েছে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া। বাজেটের ঘাটতি বেশি হলে এবং রাজস্ব আয় আর বাড়ানো কিংবা বিদেশি সাহায্যপ্রাপ্তি সম্ভব না হলে সরকারকে প্রয়োজনে বেশি সুদে জনগণের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয় সঞ্চয়পত্র ইত্যাদির মাধ্যমে। কারণ, আকর্ষণীয় হারে সুদ না পেলে জনগণ সরকারি এসব সঞ্চয়পত্র কিনতে আগ্রহী হবে না। বলা বাহুল্য, সঞ্চয়পত্র জনগণের কাছে সঞ্চয়ের মাধ্যম হলেও সরকারের জন্য ঋণ। আর এই ঋণের সুদ পরিশোধ করার জন্য সরকারকে আবার বাড়তি করারোপ করতে হয়। অর্থাৎ সরকারি দেনা বাড়লে সরকারকে প্রতিবছর সুদের বাড়তি বোঝা টানতে হয়। অথচ এই সুদের বোঝা যদি বইতে না হতো, সে অর্থ অন্য কোনো উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা যেত। এবারের বাজেটে সুদ পরিশোধের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩ হাজার ৩০২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১২ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেটেই স্বীকার করা হয়েছে ২০০৯-১০ বছরে এই সুদের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা, ২০১০-১১ বছরে ১৫ হাজার ৬২২ কোটি টাকা এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৯ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছরই সরকারের সুদের ব্যয় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
সরকারি বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে জনগণ কিংবা ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণ করা হলেও সেটি নিরঙ্কুশ নয়। প্রথমত, ব্যাংকিং খাত কিংবা জনগণের কাছ থেকে সরকারি ঋণ গ্রহণের ফলে বেসরকারি খাতে ঘাটতি দেখা দেয়। কারণ, সরকার যখন আকর্ষণীয় সুদে জনগণের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে, তার নেতিবাচক ফলাফল পড়ে ব্যাংকিং খাতের আমানতের ওপর। আর তার ফলে সীমিত হয় ব্যাংকের ঋণ সমপ্রসারণ কর্মকাণ্ড। ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা খর্ব হলে বাধাগ্রস্ত হয় বেসরকারি বিনিয়োগ, যেটি অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। স্মর্তব্য গত বছরের প্রথম থেকেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ব্যাপক তারল্যসংকটে পড়ে আছে। চলতি বছরের প্রথম দিকে সে পরিস্থিতির সামান্য কিছুটা উন্নতি ঘটলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতিসামপ্রতিক বিশেষ কিছু নির্দেশনা এবং নীতি থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংকঋণ গ্রহণের ক্ষেত্র প্রশস্ত করাই তার উদ্দেশ্য।
উপরন্তু, ব্যাংকের ঋণ সংকোচনমুখী পদক্ষেপের সঙ্গে এবারের বাজেটে করদাতা নয় এমন আমানতকারীকে প্রদেয় সুদ থেকে পাঁচ শতাংশ বাড়তি করারোপের বৈষম্যমূলক প্রস্তাব ব্যাংকের নিজস্ব আমানত সংগ্রহের সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করবে। কারণ, ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহ হারাবেন। এ কথা সত্যি, দেশে করদাতার সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক কম, কিন্তু তাই বলে যোগ্য করদাতা খুঁজে বের না করে যাঁরা যোগ্য নন, তাঁদের কাছ থেকে বাড়তি হারে কর আদায়ের উদ্যোগ যেন মেয়েকে মেরে ঝিকে শেখানোর চেষ্টা।
দ্বিতীয়ত, সরকারি বিনিয়োগ ঘটে সাধারণত বড় মেগা প্রকল্প এবং অবকাঠামো খাতে, কিন্তু শিল্প ও বাণিজ্য খাতে বিনিয়োগের মূল শক্তি বেসরকারি খাত। তবে সরকারি খাতের বিনিয়োগে বিভিন্নভাবে যে অপচয় হয়, বেসরকারি বিনিয়োগ সেই অপচয় থেকে তুলনামূলকভাবে মুক্ত।
বিগত বছরগুলোতেও আমরা সরকারের ঋণ গ্রহণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা লক্ষ করে আসছি, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে প্রকাশ করেছেন উৎকণ্ঠা ও সংশয়। ঋণ গ্রহণ করে সরকারি বিনিয়োগের পক্ষে-বিপক্ষে বহুবিধ যুক্তি আছে। একটা মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিতে সরকারি ব্যয়ের সুফলপ্রাপ্তি অমূলক নয়। ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার সময় এই কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। তবে অর্থনীতিতে অব্যবহূত সম্পদ থাকলে এই সরকারি ব্যয়ের সুফল মিলতে পারে, কিন্তু একটি পর্যায়ের পর অতিরিক্ত সরকারি ব্যয়ের ফলে অর্থনীতি অতি উত্তপ্ত হয়ে দেখা দিতে পারে মুদ্রাস্ফীতি। কারণ, ঋণ গ্রহণ করে সরকারি ব্যয় অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। এর সরাসরি ফলাফল হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। আবার এই মুদ্রাস্ফীতির ভারকে লাঘব করার জন্য সরকারকে ঋণের বিপরীতে উচ্চহারে সুদ দিতে হয়, ফলে মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়ে এবং টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এই ক্রয়ক্ষমতাকে সমুন্নত রাখার জন্য সরকারি ঋণের সুদ আরও বাড়াতে হয়। সুদের হার বাড়লে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হারও বাড়াতে হয়, যার ফলে শিল্প ও বাণিজ্যে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকের তহবিল অপ্রতুল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সরকার যদি তার রাজস্ব আয় থেকে ব্যয় করে, তার ফলাফল হয় নিরপেক্ষ। কারণ, সরকার জনগণের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে সেটিই খরচ করে, ফলে বাজারে অর্থ সরবরাহের ওপর চাপ বাড়ে না।
এ বছরের বাজেটের ঘাটতি মেটানোর জন্য যে বিশাল পরিমাণ টাকা ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে, তার সম্পূর্ণ চাপ এসে পড়বে বেসরকারি ঋণ এবং বিনিয়োগের ওপর। বিনিয়োগের গতি মন্থর হয়ে পড়লে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও কমতে বাধ্য। এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ হবে জিডিপির কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজেটের উচ্চাভিলাষ না থাকলেও এটির যথাযথ বাস্তবায়ন। এ ছাড়া সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কিছু বিষয় বাজেটের ঘাটতির ওপর চাপ ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নতুন অর্থবছর শুরু হওয়ার আগেই সারের ওপর ভর্তুকির প্রাক্কলিত বরাদ্দে টান পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আগামী বছরের বাজেটে কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ছয় হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে এই ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াতে পারে আট হাজার ২২৬ কোটি টাকায়, যদি সরকার সারের দাম না বাড়ায়। সারের দাম বাড়ালে সরকারের দুই ধরনের বিপদ। আগামী নির্বাচনের ঠিক আগের বছর এটি হবে আত্মঘাতী এবং এর বিরূপ প্রভাব পড়বে কৃষিপণ্যের দাম ও উৎপাদনের ওপর।
বাজেটের ঘাটতি মেটানোর জন্য বিদেশি সহায়তার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা যদি অর্জিত না হয় তাহলে সরকারকে আরও বেশি মাত্রায় অভ্যন্তরীণ উৎস তথা ব্যাংকব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হবে, যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া উপেক্ষণীয় হবে না। এডিপি বাস্তবায়নে বিদেশি সহায়তার অর্থ ছাড় করানোর জন্য যে অভ্যন্তরীণ অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয়, সেটি নিশ্চিত করা না গেলে বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুত অর্থও মিলবে না। সেটিও বাজেট বাস্তবায়নের পথে একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ফলে নানামুখী চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে এ বছরের বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.