দেশহীন মানুষের কথা-আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি মানে কী? by সঞ্জীব দ্রং

কয়েক দিন আগে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান স্যার ফোন করলেন। তিনি আমাদের আদিবাসীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকবার এসেছেন। আমার পরম সৌভাগ্য যে তিনি আমাকে স্নেহ করেন আর আদিবাসীদের নানা বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন। তিনি আদিবাসীদের মাতৃভাষা ও কবিতা নিয়ে আগ্রহী।


আমার কাছে কয়েকটি কবিতা চেয়েছিলেন অনেক আগে। আমি সময়মতো কবিতাগুলো তাঁকে দিতে পারিনি। প্রথম সমস্যা হলো, আদিবাসী ভাষায় লেখা কবিতা আমাদের দেশে বিকাশ লাভ করেনি। কিছু কাজ হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে, সমতলে নেই বললেই হয়। অবশেষে স্যারকে কয়েকটি কবিতা পাঠাতে পেরেছিলাম এবং বলেছিলাম, কবিতা সংগ্রহের কাজ অব্যাহত থাকবে। তারপর ফোনে স্যার বললেন, ‘আচ্ছা বলো তো, তোমরা আদিবাসীরা সাংবিধানিক স্বীকৃতি কীভাবে চাও?’ তিনিই আবার বললেন, ‘এটি পরিষ্কার করে বলো।’ বললেন, ‘পত্রিকায় দেখছি, কিন্তু পরিষ্কার হচ্ছে না।’ স্যারকে বললাম, আমরা একটি কাগজ তৈরি করছি, কীভাবে আদিবাসীদের বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করা যায়। বললাম, কাগজটি আপনাকে পাঠাব।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি মানে কী? এ বিষয়ে আমি সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করতে চাই।
প্রথমত, ১৯৭২ সালের ২৫ অক্টোবর সংসদে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংবিধানে ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার অস্তিত্ব ও অধিকারের স্বীকৃতির’ কথা বলেছিলেন (দেখুন গণপরিষদ বিতর্ক)। এমনকি তিনি সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির কথা বলেছিলেন। আদিবাসীরা সংবিধানে কী চায়, এটি বলার আগে আমি বলব যে পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানে আদিবাসীদের পরিচয়, অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও অধিকারের স্বীকৃতি আছে। যেমন, আমেরিকা, কানাডা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, ইকুয়েডর, ভেনেজুয়েলা প্রভৃতি দেশে আদিবাসী সাংবিধানিক স্বীকৃতি শুধু নয়, আদিবাসী ভূমি অধিকার ও টেরিটরির মালিকানা পর্যন্ত স্বীকৃতি পেয়েছে। নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও রাশিয়ায় আদিবাসীদের নিজস্ব পার্লামেন্ট আছে। গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের উপনিবেশ হলেও সেখানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি আছে। আফ্রিকার অনেক দেশে আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি আছে। কোথাও কোথাও বৈষম্যহীনতার কথা বলা আছে। এশিয়ার মধ্যে কম্বোডিয়া, ভারত, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, নেপাল, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাওস প্রভৃতি দেশে আদিবাসীরা হয় সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত অথবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন ও পলিসি দ্বারা স্বীকৃত।
এখন বাংলাদেশে আমরা কী চাই, তা বলছি। এর মধ্যে অনেক আদিবাসী সংগঠন নানাভাবে তাদের দাবি উত্থাপন করেছে সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়ে। রাজা দেবাশীষ রায় ও মঙ্গল কুমার চাকমাসহ আদিবাসীরা সম্মিলিতভাবে একটি কাগজ তৈরি করেছেন। আদিবাসীদের মধ্য থেকে বর্তমান সংসদে পাঁচজন সাংসদ আছেন। সবাই সরকারদলীয় এবং তাঁদের মধ্যে চারজনই প্রতিমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত। তাঁরা আদিবাসীদের সঙ্গে বসেছিলেন এবং তাঁরাও চেষ্টা করবেন আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য। সংবিধান সংশোধনী কমিটিতে আছেন দুজন সাংসদ, যাঁরা দীর্ঘদিন আদিবাসীদের সংগ্রামে পাশে ছিলেন। তাঁরা হলেন রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু। সব মিলিয়ে আদিবাসীরা আশা করছে, সংবিধানে তাদের বিষয়টি এবার অন্তর্ভুক্ত হবে। আমি নিজে এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত আছি। আমি সংক্ষেপে তুলে ধরছি যেভাবে আদিবাসী বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
সংবিধানের মৌলিক অধিকার (অনু. ২৮-এর ৪) অংশে আছে, ‘নারী ও শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ প্রস্তাব করা হচ্ছে এই অনুচ্ছেদের শুরুতে ‘আদিবাসী জাতিসমূহ’ শব্দগুলো জুড়ে দিতে হবে। এভাবে সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে ‘আদিবাসী’ শব্দ প্রতিস্থাপিত করার কথা আদিবাসীরা বলছে। যেমন, অনুচ্ছেদ ৩ বলছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, ‘তবে নাগরিকদের অন্যান্য ভাষার পরিপোষণ ও উন্নয়নেও রাষ্ট্র সমভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করিবেন।’ এ রকম বেশ কয়েকটি সংশোধন চায় আদিবাসীরা। তবে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো প্রস্তাবনার শুরুতে পৃথিবীর অনেক দেশের মতো ‘বাংলাদেশ বহু ভাষা, বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ’ এ রকম একটি লাইন রাখা, যা সব জাতির পরিচয় ও সংস্কৃতিকে স্থান দেবে, রাষ্ট্র হবে সবার।
আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, আদিবাসীদের অধিকার দিলে, সম্মান করলে রাষ্ট্র নিজেই সম্মানিত হবে। অতীতে আদিবাসীদের প্রতি যে অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে, জাতিসংঘ নিজে এ কথা বলছে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আদিবাসীদের উন্নয়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। এখন জাতিসংঘ আদিবাসী দ্বিতীয় দশক চলছে ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত। সুতরাং এখন আমরা সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতির আশা করতেই পারি।
সঞ্জীব দ্রং: লেখক ও আদিবাসী সংগঠক।
sanjeebdrong@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.