জনদুর্ভোগ-অভ্যর্থনা জানানোর এই ধরন থেকে কি সরে আসা যায় না? by জায়েদুল আহসান

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে অভিনন্দন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি), বিশেষ করে শিশুমৃত্যুর হার কমানোয় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করায় আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এ বছর জাতিসংঘ পুরস্কার পেয়েছে। আর এ কারণে আপনাকে দলীয় নেতা-কর্মী আর সমর্থকেরা অভ্যর্থনা জানাতেই পারেন।


সাধারণ মানুষেরও ইচ্ছা হতে পারে সেই অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে শামিল হওয়ার। কিন্তু সেই অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানটি কোন প্রক্রিয়ায় কীভাবে হতে পারে, এ নিয়ে মনে হয় আপনাকে আরেকটু ভাবতে হবে।
আমরা জানি, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে হাজারটা জটিল বিষয় নিয়ে আপনাকে ভাবতে হয়। আমরা এও জানি, আপনি একজন সংবেদনশীল মানুষ। আর তাই আপনাকে ভাবতে বলেছি, তার অন্যতম কারণ হলো, অভ্যর্থনা জানানোর সংস্কৃতির তথাকথিত ধরন থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দেওয়া দরকার। এই সংস্কৃতির শিকার হয় লাখো মানুষ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, ২৯ সেপ্টেম্বর বিকেল থেকে রাত অবধি ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে কী হয়েছিল? আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আরও কিছু সংগঠনের মিছিলে আটকে যায় এই মহাসড়কের দুই দিকের যানবাহন। আপনি তো নিজেই দেখেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। সে সময় যানজটে আটকে ছিল লক্ষাধিক সাধারণ মানুষ। রাত আটটার দিকে যখন আপনি বিমানবন্দর থেকে গণভবনের উদ্দেশে রওনা হন, তখন বিমানবন্দরের সামনের গোলচত্বর থেকেই গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। অবশ্য বিকেলের পর থেকেই এই রাস্তায় যানবাহন চলাচল প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। উত্তরার শেষ মাথা পর্যন্ত সব যানবাহন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এর প্রভাব পড়েছে পুরো শহরে। রাস্তার দুই পাশেই প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে আসা নেতা-কর্মীদের বহনকারী বাস, মাইক্রোবাস, ট্রাক, গাড়ি ও মোটরসাইকেল পার্ক করে রাখা ছিল।
অবস্থা এতটাই খারাপের দিকে গিয়েছিল যে আপনার দলের লোকজনও সেটা বুঝতে পেরে চেষ্টা করেছে কিছু একটা করার। আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের পক্ষ থেকে মাইকিং করে কর্মীদের সড়কের দুই পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে যান চলাচলের সুযোগ করে দিতে বলা হয়েছিল।
এর প্রভাব মানুষের ওপর কেমন পড়েছে, সেদিকটা একটু শুনুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি খবর উল্লেখ করছি, সেদিন সন্ধ্যা সাতটা ৫৪ মিনিটে দুজন বিদেশিকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাশ কাটিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বিমানবন্দরের দিকে যেতে দেখা গেছে। তাঁদের মধ্যে মারিয়া নামের একজন জানান, তাঁরা কোথায় গাড়ি থেকে নেমেছেন তা জানেন না। তবে ১০ মিনিট ধরে তাঁরা হাঁটছেন। তাঁরা ডেনমার্কের নাগরিক এবং রাত সাড়ে আটটায় তাঁদের ফিরতি ফ্লাইট। ভিভিআইপি টার্মিনালের প্রবেশপথের সামনে লক্ষ্মীপুরের ইসমাইল ও মোহাম্মদ চৌধুরী জানান, তাঁরা বিশ্বরোডে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটছেন। রাত নয়টার ফ্লাইটে তাঁদের সৌদি আরবে যাওয়ার কথা।
যারা উত্তরা, টঙ্গী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও উত্তরবঙ্গের যাত্রী, তাদের উদাহরণ আর দিলাম না। কারণ, নিশ্চয়ই তাঁদের এই অভিজ্ঞতা নতুন নয়। একটু ভাবুন, ডেনমার্কের ওই মারিয়া কী ধারণা নিয়ে এ দেশ থেকে গেলেন? তাঁর মতো আরও অনেক মারিয়ার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই সুখকর কিছু নয়। প্রতিদিনই নানা ফ্লাইটে বিদেশে যাচ্ছেন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি। ওই একটিমাত্র সড়ক দিয়ে তাঁদের বিমানবন্দরে যেতে হয়। রাস্তায় যদি কয়েক ঘণ্টা বিনা নোটিশে তাঁদের বসে থাকতে হয়, তাহলে ফ্লাইট মিস করার দায়িত্বটা কে নেবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ সমস্যার কথা আপনি জানেন না, এটা আমরা মানতে নারাজ। কারণ, সেদিন আপনাকে স্বাগত জানাতে আসা মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও বিমানবন্দরের ভিভিআইপি লাউঞ্জে ঢুকতে বেগ পেতে হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, কোনো না কোনো মন্ত্রী এ কথা আপনার কানে তুলেছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ দেশের মানুষের রাস্তার ওপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকার অভিজ্ঞতা আছে। ধীরে ধীরে গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে বিষয়টা। কিন্তু আপনার সাফল্যে যাঁরা আনন্দিত, তাঁদের আনন্দ প্রকাশের জন্য লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে কি ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা করা যায় না? আমরা আশা করি, আপনি আরও পুরস্কার পাবেন। আপনাকে আরও অভ্যর্থনা জানানো হবে। আপনার দল বা দেশবাসী যদি আপনাকে অভ্যর্থনা বা আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন জানাতেই চায়, তাহলে একটা তারিখ ঠিক করে অন্য কোনো খোলা জায়গায় কি তার আয়োজন করা সম্ভব নয়? তাহলে তো সাধারণ জনগণও তাতে অংশ নিতে পারে। তাদেরও তো শখ থাকতে পারে তাদের প্রধানমন্ত্রীকে একটু অভিনন্দন জানানোর। তাদের কেন বঞ্চিত করছেন?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা প্রায়ই খবর পাই... অমুক জায়গায় যানজটে আটকা পড়ে তার আর হাসপাতালে যাওয়া হলো না... যানজটে আটকা পড়ে অমুকের মৃত্যু...। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এবার আমরা কল্পনায় ফিরে যাই। আপনাকে অভ্যর্থনা দিতে গিয়ে যেদিন লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় আটকা পড়েছিল, সেদিন তো কোনো না কোনো একটি বাসে বা স্কুটারে বা কোনো একটি অ্যাম্বুলেন্সে হয়তো এমন কেউ ছিলেন, যাঁকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে হবে। হতে পারেন তিনি একজন গর্ভবতী। মুমূর্ষু অবস্থা। সময়মতো হাসপাতালে নিতে না পারলে শিশু বা মা কাউকে বাঁচানো যাবে না। এমন হতেও তো পারে, তাই না?
গত ৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর একটি সংবাদ মনে পড়ে গেল—পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী: রাজধানীর জয়কালী মন্দিরে যানজটে আটকা পড়ে আছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। চালক প্রাণপণে বাজিয়ে যাচ্ছেন হর্ন। সামনের রাস্তা বন্ধ, বেরোনোর কোনো পথ নেই। তাঁর গাড়িতে চার দিনের একটি ফুটফুটে ছোট্ট শিশু একটু পরপর কেঁদে উঠছে। শিশুটির সঙ্গে সঙ্গে তার মাও কাঁদছেন। কখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, কখনো উচ্চ স্বরে। আশা-নিরাশার দোলায় দুলছে মায়ের মন। একে-ওকে জিজ্ঞাসা করেন, বাঁচবে তো তাঁর নাড়িছেঁড়া ধন?...শিশুটি সুস্থ হয়ে আর বাড়ি ফিরতে পারেনি। মাতুয়াইলের শিশুমাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পথে শিশুটি মারা গেল। থেমে গেল অ্যাম্বুলেন্সের হর্ন, ট্রাফিক সার্জেন্টের যানজট ছোটানোর আপ্রাণ চেষ্টা। মৃত শিশুকে বুকে চেপে ফিরে গেলেন মা আমেনা বেগম আর বাবা হারুন অর রশীদ।
যানজট আমাদের জীবনে কী ধরনের করুণ ঘটনার জন্ম দিতে পারে, এই খবরটি তার একটি দৃষ্টান্ত।
জায়েদুল আহসান: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.