শিক্ষকদের সংবেদনশীলতা বাড়ানো প্রয়োজন-শিক্ষার্থী নির্যাতন

উচ্চ আদালতের নির্দেশনাক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করার পরও শিক্ষার্থী নির্যাতন বন্ধ হয়নি—শিশু অধিকার সপ্তাহ শুরুর দিনে এই সংবাদ আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না।


সোমবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত প্রধান প্রতিবেদনটিতে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকদের হাতে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে, যা থেকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অসংবেদনশীলতা ও নির্মমতার পরিচয় ফুটে ওঠে। সহপাঠীদের সামনে জুতো দিয়ে পেটানো, বেত দিয়ে মাথায় আঘাত করা, চুল কেটে দেওয়া, বেদম প্রহার করে আহত করা, বেঞ্চের নিচে মাথা ঢুকিয়ে শাস্তি দেওয়া—এ ধরনের নানা শারীরিক নির্যাতনের চিত্র পাওয়া যায়। সাত বছরের শিশুকেও প্রহার করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে শিক্ষার্থী নির্যাতনের এসব প্রবণতা লক্ষ করা যায়। একাধিক কোমলপ্রাণ শিশু শিক্ষকের নির্যাতনে আত্মহত্যা করে, কেউ মানসিক ভারসাম্য হারায়, কেউ শারীরিকভাবে স্থায়ী ক্ষতির শিকার হয়। শুধু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয় বা মাদ্রাসায় নয়, শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে রাজধানীর নামকরা বিদ্যালয়েও।
শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের সংবেদনশীলতা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, এ উপলব্ধির অভাব রয়েছে আমাদের সমাজে। অনেক মা-বাবাও শিশুসন্তানদের পড়াশোনার জন্য প্রচণ্ড মানসিক চাপের পাশাপাশি প্রহার করতেও দ্বিধা করেন না। কিন্তু এ ধরনের কঠোর আচরণ যে শিশুদের জন্য মানসিক ও শারীরিক উভয় দিক থেকেই ক্ষতিকর—এই সচেতনতার অভাব রয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও দুটি মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির পর শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা কিছু কমেছে বলে খবর পাওয়া গেছে, কিন্তু বন্ধ হয়নি। প্রজ্ঞাপনটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়নি, অনেক শিক্ষক এ বিষয়ে কিছু জানেন না—এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানিয়েছেন, শিক্ষার্থী নির্যাতন বন্ধ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে জেলা-উপজেলায় শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশ পালনে জেলা-উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা দুই রকম পদক্ষেপ নিতে পারেন। এক. প্রতিটি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের জানিয়ে দেওয়া যে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া অসদাচরণ বলে গণ্য করা হবে। দুই. শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষকদের নিয়ে যৌথ সভায় বসে তাঁরা শিশু শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, ব্যক্তিগত আচরণ ইত্যাদি উন্নয়নের লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। শ্রেণীকক্ষে রং-পেনসিল না আনার শাস্তি হিসেবে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা যখন ২০ জন শিশুছাত্রীকে প্রহার করেন, বা পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েছে বলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিশুকে তার শিক্ষিকা যখন বেদম প্রহার করেন, তখন মনে হয়, আমাদের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণও প্রয়োজন। তবে এও সত্য যে এমন শিক্ষকও অনেক রয়েছেন, যাঁরা শিশুদের প্রতি সংবেদনশীল এবং স্নেহ-মমতার দ্বারা শিশুদের পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সরকারের দুটি প্রজ্ঞাপনের আলোকে তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে শিশু-কিশোরদের জন্য শিক্ষাঙ্গনকে আনন্দদায়ক করে তুলতে সচেষ্ট হলে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে।

No comments

Powered by Blogger.