প্রতিক্রিয়া-পাবনা থেকে আমরা কী পেলাম

অবশেষে পাবনার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ বেশ কজন ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে সরকার প্রত্যাহার করেছে। ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপনবিষয়ক উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পাবনা মিশনে যান। সে সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সভা শেষে ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করার দায় চাপান গণমাধ্যমের ওপর।


উপদেষ্টা আর প্রতিমন্ত্রী যখন ‘সরকারি চাকরিতে কেউ এক স্থানে স্থায়ী নয়’ বলে অভিমত দিয়েছিলেন, তখনই আমরা বুঝেছিলাম অশ্রু বিসর্জনকারী জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাবনায় দায়িত্ব পালনের সময় ফুরিয়ে এসেছে, তবে এটা যে এত দ্রুত হবে, তা আঁচ করতে পারিনি। এর মধ্য দিয়ে যে সত্য প্রমাণিত হয়েছে, তা হলো, সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া পূরণে সরকার মাসের পর মাস কালক্ষেপণ করে ঠিকই কিন্তু দলীয় কর্মীদের দাবি পূরণ করে আলোর গতিতে!
সরকারের এই ত্বরিত সিদ্ধান্ত আমাদের মতো ক্ষমতার পাটাতনের নিচে থাকা আমজনতার কাছে বেজায় খটকা লেগেছে। ১৭ সেপ্টেম্বর থেকেই সরকারি দলের সাংসদসহ একশ্রেণীর নেতা-কর্মীর দাবি ছিল, জেলা প্রশাসনের সেই সব কর্মকর্তাকে সরিয়ে নিতে হবে, যাঁরা সেখানে তাঁদের কথা শুনছেন না। কর্মকর্তাদের দ্রুত বদলির এই সরকারি সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের কাছে অনেক দিন পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকবে; কারণ সরকারের ত্বরিত উদ্যোগ ছিল একপেশে; ঘটনা ঘটার প্রায় ১৩ দিন পর সরকারের প্রতিনিধিরা কর্মকর্তাদের অভয় দিতে গেছেন আর নিজ কর্মীদের দাবি পূরণ করেছেন মাত্র ২০ ঘণ্টার ব্যবধানে!
এর মধ্য দিয়ে দেশের সবখানে কর্মরত প্রশাসনকে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে যে কোথাও প্রশাসনের কর্মকর্তারা যেন পাবনার প্রশাসন যা করেছে, তার পুনরাবৃত্তি না করেন। তাঁরা যেন এক. দলীয় সাংসদদের আর নেতা-কর্মীদের ‘সহযোগিতা’ প্রত্যাখ্যান না করেন। দুই. যদি কখনো সরকারদলীয় ক্যাডারদের হাতে হেনস্তার শিকার হন, তা যেন হজম করেন। তিন. হেনস্তার মাত্রা বেশি হলে অশ্রু বিসর্জন করে মনের ভার হালকা করার চেষ্টা করেন। আর দলীয় কর্মীরা যে বার্তাটি পেলেন তা হলো, কোথাও যদি পাবনার মতো বেয়াড়া প্রশাসন দলের নেতা-কর্মীদের ‘সহযোগিতা’ নিয়ে না চলেন, আর তাঁদের সঙ্গে যদি বিরোধে জড়ান, তাহলে ছোটখাটো ধমক, জেল-জরিমানা হলেও শেষ পর্যন্ত দলীয় কর্মীরাই ‘বিজয়ী হবেন’।
প্রায় ১৫ দিনের নানা খেলা শেষে খোলা মন নিয়ে আজ যদি প্রশ্ন করি, পাবনায় জিতল কে? সরকার তার কর্মচারীদের প্রত্যাহার করে দলীয় কর্মীদের অন্যায্য দাবি পূরণ করে তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করেছে। আপাতদৃষ্টিতে সমস্যার একটা সমাধান পাওয়া গেছে, যা সরকারকে স্বস্তি এনে দিয়েছে। আর কিছু অভিযুক্ত নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের দাবিও পূরণ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের বিবেচনায়, এ ঘটনার সুদূরপ্রসারী পরিণতির বিচারে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, এতে প্রশাসনের ওপর ভবিষ্যতে সরকারি দলের চাপ বাড়বে, তাঁরা নিজেদের সুবিধা আদায়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবেন, আর তার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধবে।
প্রশাসনে অস্থিরতা, ফাইলের শ্লথগতি কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ার খবর প্রায়ই সংবাদপত্রে দেখা যায়। ‘নির্বাচিত প্রতিনিধি’ বনাম ‘সরকারি কর্মকর্তা’র মধ্যে বনিবনা না হওয়ার খবরও আমরা পাচ্ছি। কোথাও তা অশোভন পর্যায়েও চলে যাচ্ছে। সাভার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমি সরকারি কর্মকর্তাকে ধমক দিতেই পারি।’ কিন্তু তিনি কেন ধমক দিচ্ছেন? জনস্বার্থে না ব্যক্তিগত কারণে। আরেকজন প্রতিনিধি বলেছেন, ‘আমিই উপজেলার মালিক।’ এটা ঠিক যে জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে দাবি আদায় করা আমাদের দেশে একটি প্রচলিত রাজনৈতিক কৌশল; কিন্তু ক্ষমতার জোরে আজ তা করা হচ্ছে ব্যক্তিগত লাভ ও লোভের কারণে।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতাদের দুষ্কর্মের কথা স্মরণ করুন। স্মরণ করুন রাজশাহীর বানেশ্বর মাঠে সোনার মুকুটধারী সাংসদের পরিণতির কথা, কুষ্টিয়ার মোল্লা পরিবারের সুসন্তানদের(?) কথা, যাঁরা নিজেরা সোনার মুকুট পরলেও দলের জন্য বিরাট গর্ত খুঁড়ে রেখে এসেছিলেন; মুকুটমণিদের খোঁড়া গর্তে বিএনপিকে আজ অসহায় কাল কাটাতে হচ্ছে। আমরা বলতে পারব না পাবনায় সরকারি দলের নেতারা আওয়ামী লীগের জন্য এ ধরনের গর্ত খুঁড়লেন কি না। তবে আজ পাবনা, সাভার অথবা চট্টগ্রাম, ভোলা, পটুয়াখালী, কক্সবাজারসহ অন্যান্য জায়গা থেকে যে খবর আসছে, তা সরকারের জন্য মোটেও শুভকর নয়। ভয়ের ব্যাপার যে তালিকাটি ক্রমেই বাড়ছে। আমরা আশা করব, এই তালিকা যাতে আর দীর্ঘ না হয়, তার জন্য প্রধানমন্ত্রী দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন। নইলে সরকারের অনেক কল্যাণকর উদ্যোগ, বিরাট প্রচেষ্টা, সাহসী সিদ্ধান্ত আর মহৎ অর্জন সব ম্লান হয়ে যাবে। সরকার বারবার মানুষকে দিনবদলের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। মনে রাখা দরকার, এই দিনবদল যেন পচা মোল্লাদের পরিবর্তে প্রিন্সদের শাসনে ফিরে যাওয়া না হয়। জেলা প্রশাসককে পেটানো, সিভিল সার্জনের হাত ভেঙে দেওয়া দিনবদলের চেষ্টার সদিচ্ছার প্রমাণ দেয় না।
দুঃখজনক যে গেল দুই দশকে গণতন্ত্রের গাড়িটি কিছুটা পথ পাড়ি দিলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন খুব একটা হয়নি। মানুষের পবিত্র বিশ্বাস আর সমর্থনকে আগলে রাখার যে সততা আর বিচক্ষণতার দরকার, তা আমাদের শাসকেরা বা তাঁদের নেতা-কর্মীরা কখনোই দেখাতে পারেননি এবং তার চেষ্টাও করেননি। হয়তো সে কারণে আজ সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পাল্টে যাচ্ছে—দরিদ্র/যোগ্য যুবকদের চেয়ে সচ্ছল/অযোগ্য দলীয় কর্মীদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার বিষয়টি সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আজ সরকার যদি সত্যি সত্যি পাবনার ঘটনাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে নিজে বিশ্বাস করে এবং আমাদের আশ্বস্ত করতে চায়, তাহলে ‘স্নেহ-মমতা’র ঊর্ধ্বে উঠে সরকারকে কঠোর হতে হবে। প্লেটোর রাষ্ট্রতত্ত্ব মনে রেখে জনগণের জন্য কোমল আর দলীয় প্রিন্সদের জন্য কঠোর হতে হবে, না হলে বিগত সরকারের মতো নিজেদের খোঁড়া বিপজ্জনক গর্তে নিজেদেরই পড়তে হবে।
লেখকেরা মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, প্রকৌশলী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.