বিদ্রোহের প্রতীক সিধু-কানু by এমএম কবীর মামুন

ঘটনাটি আজ থেকে ১৫৬ বছর আগের। সেই দিন নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় সাঁওতাল আদিবাসীরা গর্জে উঠেছিল। আজকের নিপীড়িত সাঁওতালদের দেখে এটা অনুমান করা খুব কঠিন যে, তারাই একদিন ব্রিটিশ বেনিয়াদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল।


জমিদার, মহাজন এবং ইংরেজদের শাসনব্যবস্থার চরম শোষণে বঞ্চনা-নির্যাতন-দাসত্ব আর নারীর অবমাননায় দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সাঁওতালরা। একদিকে জমিদার আর মহাজনদের ঋণের নাগপাশ, অন্যদিকে ইংরেজ শাসনের খাজনার চাপ সাঁওতালদের বাঁচিয়ে রেখে মৃত্যুযন্ত্রণা দিচ্ছিল। ফলে নিরীহ সাঁওতালরা হয়ে উঠল বিদ্রোহী। সাঁওতাালি ভাষায় বিদ্রোহকে বলা হয় 'হুল'। তাই এই বিদ্রোহ সাঁওতাল হুল নামেও পরিচিত। বিক্ষুব্ধদের এই বিদ্রোহ আত্মপ্রকাশ করে ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন। সাঁওতালদের এই দুর্দিনে হাল ধরেছিল তাদের নেতা সিধু-কানু-চাঁদ-ভায়রো-ফুলমনি আর জানমনি।
১৭৬৫ সালের আগস্টে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করেছিল সেদিন থেকেই শুরু শোষণের। তবে বিদ্রোহের শুরু হয়েছিল ১৮৫৪ সালের শেষ দিকে এসে। এই সময় গোক্কো নামের এক ধনী সাঁওতালকে চুরির দায়ে বেঁধে নিয়ে গেলে সাঁওতাল জাতি প্রতিশোধ নিতে অঙ্গীকার করে এবং ১৮৫৫ সালের প্রথম দিকে বীরভূম, বাকুড়া, ছোটনাগপুর ও হাজারীবাগ থেকে প্রায় সাত হাজার সাঁওতাল 'দামিন' অঞ্চলে একত্র হয়ে প্রতিবাদ জানায়। এরপর শুরু হয় পুলিশি আক্রমণ। মহেশলাল দারোগার নেতৃত্বে সাঁওতাল গ্রামে পুলিশ ঢুকে সাঁওতালদের গ্রেফতার করে এবং নিপীড়ন চালায়। একে তো অস্তিত্বের সংকট তার ওপর পুলিশি সন্ত্রাস_ এর প্রতিবাদে ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সিধু-কানুর গ্রাম ভাগনাদিহিতে প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল এক প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেয়। এই ১০ হাজার সাঁওতাল সেদিন সাঁওতাল পরগনা থেকে অত্যাচারীদের হটিয়ে দিয়ে নিজেদের স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে। সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরুর আগে তারা কর্তৃপক্ষকে তাদের দাবি-দাওয়া জানিয়ে চিঠি দেয়। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন তারা কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে তাদের দাবি জানানোর জন্য। প্রায় ৩০ হাজার সাঁওতাল একত্রে যাত্রা শুরু করেছিল। তাদের নেতা ছিল সিধুু মাঝি-কানু মাঝি। এই পদযাত্রার মাধ্যমেই শুরু হয়ে যায় সাঁওতাল বিদ্রোহের। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিধু-কানুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটলেও তা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুনমাত্রা যোগ করে। এই বিদ্রোহ সাঁওতালরা শুরু করলেও তাদের এই সশস্ত্র অভিযানে আরও অনেকে শামিল হয়েছিল। যেমন_ গোয়ালা, তেলি, কর্মকার এমনকি দরিদ্র নিপীড়িত মুসলমানরাও তাদের সঙ্গে এই সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। ফলে এ সংগ্রাম উৎপীড়কের বিরুদ্ধে উৎপীড়িত মানুষের সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল।
এই সাঁওতাল বিদ্রোহ শেষ হতে না হতেই শুরু হয়েছিল সিপাহি বিদ্রোহ। তারপর থেকেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে শাণিত হতে থাকে মানুষের চেতনা আর গাঢ় হতে থাকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা। ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে তারপর অব্যাহত আন্দোলনের ফলে এ অঞ্চলের মানুষ মুক্ত হয় ব্রিটিশ শোষণ থেকে। কিন্তু শুরুটা করেছিল সাঁওতালরা আর তার নেতৃত্ব দিয়েছিল সিধু-কানু।
্এখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনো ঘটনার প্রতিবাদে যে স্মারকলিপি দেয় অথবা পদযাত্রা করে তা আজ থেকে ১৫৬ বছর আগে এই সাঁওতালরাই সূত্রপাত ঘটায়। সিধু-কানু নাম দুটি আজ অন্যায়-অত্যাচার-নিপীড়ন-নির্যাতন-শোষণ-বঞ্চনা আর উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।
আজ দেশ স্বাধীন। ব্রিটিশরা নেই, পাকিস্তানিরাও নেই, তবুও স্বাধীন দেশে অনেক সমস্যার পাশাপাশি আত্মপরিচয়ের জন্য সংগ্রাম করছে আদিবাসীরা। তারা কখনও 'ট্রাইবাল', কখনও 'উপজাতি', কখনওবা 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী' নামে পরিচিত হচ্ছে। বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকটে বাঙালি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল (১৯৫২-১৯৭১)। কিন্তু আজ দেশ স্বাধীন আর বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এই সরকারকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। আদিবাসীদের আদিবাসী নামেই স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এসে গেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সংবিধানে আমাদের যতটুকু পারা না পারা ছিল তা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটা প্রয়োজন। সরকার আজ নতুন করে সংবিধান সংশোধন করছে, এই সংবিধানে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে_ এটাই প্রত্যাশা।
krmamun334@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.