শিল্পীর ভুবন-অধিচৈতন্যের সুর by সিলভিয়া নাজনীন

মানুষ সম্ভবত শিল্পেরই সারাৎসার অথবা শিল্পই মানুষের মুখ্যতম অভিব্যক্তি। নতুবা শিল্পীই কেন বা সৃজনে বিভোর আর মানুষের তন্ময় মন কেনই বা তার অকারণ অনুগামী? দেহ-মন-চৈতন্যে এমনই সৃজনমগ্ন শিল্পী ঢালী আল মামুন। কথা হচ্ছিল তাঁর ঢাকার অস্থায়ী স্টুডিওতে শিল্প-শিল্পী-সমাজ-রাজনীতি, বিবিধ প্রসঙ্গে।


একটি দেশের জনগোষ্ঠীর সংবেদনশীলতাকে পরিচর্যা করে শিল্পীরা যেকোনো সমাজের ক্ষত, স্খলনের উপশম ঘটাতে সক্ষম। তবে এই সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন অনুধ্যান থাকতে হয়। ‘আমরা নিজের চিন্তা অপেক্ষা অন্যের চিন্তাকে প্রাধান্য দিই। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা আমাদের এই আত্মিক সংকট তৈরি করে দিয়েছে। এই সংকট এতটাই প্রকট যে নান্দনিক, একাডেমিক বা সৃজনশীলতার আর কোনো বিস্মৃতি ঘটেনি।’ শিল্পী ঢালী বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের শিল্পচর্চা সম্পর্কে এভাবেই তাঁর হতাশা ব্যক্ত করেন। পঞ্চাশের দশকের শিল্পীরা আধুনিকতার চর্চা করতে গিয়ে পশ্চিমা শিল্পের যা কিছু ধার করেছিলেন, এই বর্তমান সময়ে পুনরায় তা ফিরে এসেছে। এই সংকট মোকাবিলা করার কথা এখনই ভাবতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
তরুণ প্রজন্ম শিল্প নিয়ে বিভিন্ন নিরীক্ষা করছে একটি নতুন শিল্পভাষা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু শিল্পকলাচর্চায় এখন পারিপার্শ্বিক নানা বিষয়—প্রেট্রোনাইজেশন, অ্যাপ্রিসিয়েশন, এমনকি বাজার অর্থনীতিও বড় ভূমিকা পালন করে। তবে নতুন প্রজন্ম শিল্পকলাকে কোন অবস্থানে দেখতে চায়, তা উপস্থাপিত হয় তাদের শিল্পকর্ম ও ভাবনায়।
নানা ধরনের শিল্পীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজ একধরনের নির্মিতি লাভ করে। মহৎ শিল্পীর সমাজলগ্নতা তাই অনিবার্য বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে শিল্পী ঢালী আল মামুন বলেন, ‘জানি না, একজন শিল্পীর সমাজের প্রতি আদৌ কোনো দায়বদ্ধতা রয়েছে কি না, তবে শিল্পীরা হলেন একটি জনগোষ্ঠীর সংবেদনশীলতা বোঝার প্রকৃষ্ট মাপকাঠি। পূর্ববর্তী সমাজব্যবস্থায় যে ধরনের বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল, বর্তমান সামাজিক কাঠামোতে তার প্রয়োজন নেই বললেই চলে। আবার সমসাময়িক কালে শিল্প-দর্শকের যে ব্যাপ্তি হওয়ার কথা তেমন নেই! ফলে শিল্পচর্চা দিয়ে সমাজ পরিবর্তন কঠিন এ সময়ে। এটা শুধুই শিল্পীদের দায়ভার নয় বরং সমাজেরও ভুল রয়েছে। কারণ সমাজ-শিল্প-শিল্পী প্রত্যেকেই পারস্পরিক সম্পর্কিত। কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থায় যেকোনো মানুষ শিল্প দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনুপ্রাণিত হতেই পারে। তবে সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্র— এই দুইয়ের প্রভাব মানুষের সংবেদনশীলতাকে প্রভাবিত করছে।’
শিল্পী ঢালী আল মামুনের এ বছর একটি প্রদর্শনীর পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি ‘জেনোসাইড’ বিষয়টি নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনের কথা ভাবছেন। শুধু ‘কিলিং অব কমিউনিটি’ জেনোসাইড নয়; বরং একটি প্রাকৃতিক বা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় উপাদানের বিলুপ্তির কারণে একটি জনগোষ্ঠীর ধ্বংসের প্রক্রিয়াও জেনোসাইডের অন্তর্ভুক্ত। তাই শিল্পী ঢালী এই শব্দের বিভিন্ন ব্যাখ্যা নিয়ে শৈল্পিক রূপান্তরের কথা ভাবছেন। তাঁর প্রায় সব কাজেই উঠে আসে সমসাময়িক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। একজন পরিপূর্ণ সমাজসচেতন শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন আশির দশকের ‘সময়’ গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য। পারিপার্শ্বিকতার নান্দনিক উপস্থাপনে শিল্পী ঢালী আল মামুনের সংবেদনশীলতা আমাদের প্রাপ্তির আকাশকে রঙিন করে রাখবে দীর্ঘকাল।
তিনি বলেন, যে আর্ট স্পিরিচুয়্যালিটি ক্রিয়েট করে না, তা আর্ট হিসেবে কনসিডার করা তার জন্য কঠিন। আর্টের পুরো ওয়ার্কিং প্রসেসটাই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আইডিয়া, কনসেপ্ট, টাইম, স্পেস, এলিমেন্ট, অবজেক্ট, চেঞ্জ—এ সবকিছুই ইম্পোর্টেন্ট। এই সবকিছু মিলিয়ে যে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য সৃজনলহরি তৈরি হয়, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে।
‘শিল্পে স্টাইল অপেক্ষা ল্যাঙ্গুয়েজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ’। ভাষা একটি পরিপূর্ণ চিন্তার কাঠামোকে বিবৃত করে। আর শিল্প হলো ভাবনা প্রকাশের মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে পারস্পরিক যোগাযোগ তৈরির মাধ্যম। এই জটিল জায়গাতেই শিল্পীর কাজ। ‘আর স্টাইল শিল্পীকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়; অভ্যাসের দাসে পরিণত করে, নিজেকেই অনুকরণ করতে শেখায়।’

শিল্পী ঢালী আল মামুন: জন্ম ১৯৫৮ সালে চাঁদপুরে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগে বিএফএ ও এমএফএ করেন। দেশে-বিদেশে তিনি বহু একক এবং যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

No comments

Powered by Blogger.