ভারত-কাশ্মীরে শান্তির জন্য by কুলদীপ নায়ার

কিছুদিন আগে জম্মু ও কাশ্মীরে যে সর্বদলীয় সংসদীয় প্রতিনিধিদল সফর করেছে, তারা কোনো জাদু দেখাবে, তা আমি আশা করিনি। কিন্তু আমার বিশ্বাস, বছরের পর বছর ধরে যে সমস্যা জমাট হয়ে আছে, তা গলা শুরু করবে। কয়েকজন সাংসদ, যাঁদের মধ্যে বামপন্থীরাই বেশি, বলেছেন কাশ্মীর উপত্যকায় পরিস্থিতি যেমন আছে, তেমন চলতে পারে না।


তাঁরা সরকারের কাছে এ বিষয়ে কোনো রোডম্যাপ আশা করেছেন।
এই বিন্দুতেই সংসদীয় প্রতিনিধিদল বিমূঢ় হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের কোনো রোডম্যাপ নেই। সমস্যার সমাধান তারা চায়। কিন্তু এমন কোনো বাস্তব পরিকল্পনা তাদের নেই, যেটা তারা প্রস্তাব করতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদাম্বরম কাশ্মীর ঘুরে এসে একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। তাঁর সেই প্যাকেজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, তিনজন সমঝোতাকারী নিয়োগ করা। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক রূপরেখা ছাড়া তাঁদের সমঝোতার চেষ্টা হয়ে দাঁড়াবে বুনো হাঁসের পেছনে ছোটার মতো।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং জানিয়েছেন, সংবিধানসম্মত যেকোনো প্রস্তাবই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। তার পরও সমঝোতাকারীরা কী কী হতে পারে, তা হাতড়ে বেড়াবেন। কোনো ধরনের সমাধানের পথ যদি তাঁরা বের করতেও চান, তাহলেও সরকারের মনে কী আছে তা না জানলে তাঁদের পক্ষে কাশ্মীরিদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে দর-কষাকষি করা সম্ভব হবে না।
এবং সংবাদ প্রতিবেদনমতে, সমঝোতাকারীদের মধ্যে রাজনীতিক থাকলেও তাঁর কাজ আরও কঠিন হয়ে যাবে। রাজনীতিকদের নানা ঝুট-ঝামেলা থাকে এবং তাঁরা দলের লোক। তা ছাড়া তাঁদের পক্ষেই সমঝোতার কাজ করা সম্ভব, যাঁরা একই সঙ্গে কাশ্মীর ও ভারতে গ্রহণযোগ্য হবেন। আবার একই সঙ্গে সরকার ও জনগণকে সন্তুষ্ট করা প্রায় অসম্ভব।
অন্যদিকে যাঁরা আজাদি চাইছেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে, সমাধানটা আসতে হবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত থাকার মাধ্যমেই, তা সংবিধানসম্মত হোক বা না হোক। আমার ধারণা, কাশ্মীরের বিভিন্ন দল এটা বোঝে। তাদের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন হলেও অন্তরের অন্তস্তল থেকে তারা মানে যে বিচ্ছিন্নতা অসম্ভব।
কাশ্মীর উপত্যকায় সবার আগে দরকার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা। আর সেই দায়িত্ব প্রধানত সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহর এবং তিনি তাতে ব্যর্থ হয়েছেন। জনগণের মধ্যে যে অনাস্থা ও দূরত্ববোধ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। বছরের পর বছর ধরে কাশ্মীরিরা যে অমানবিক জীবন যাপন করে আসছে—এখন হয়তো তা আরও খারাপ হয়ে গেছে—তার অবসানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিদ্রোহী নেতা ইয়াসিন মালিক সহিংসতার পথ ছেড়ে অহিংস আন্দোলন শুরু করলেও নয়াদিল্লি তাঁর বা তাঁর মতো নেতাদের সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজনবোধ করেনি। এভাবে তারা হারিয়েছে স্বর্ণ সুুযোগ।
রাজনীতির ময়দান থেকে যখন কোনো সমাধান আসছে না, তখন তরুণেরা বিক্ষুব্ধ হতে এবং পাথর ছোড়ার মতো পথ বেছে নিতে বাধ্য। তারা যে আপসহীন পথ নিয়েছে তা সাময়িক। কেননা, মৌলবাদ আর কাশ্মীরিয়াত একসঙ্গে চলতে পারে না। কাশ্মীরিরা ধর্মনিরপেক্ষ। সংঘাতের ঝড় থেমে গেলে এবং প্রতিবাদ স্তিমিত হয়ে এলে আবার সেই দর্শন সামনে আসতে বাধ্য।
নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়াবাড়িতে কাশ্মীরের কিছু সাংসদ যে বিদ্রোহীভাবাপন্ন হয়েছেন, তাও স্বাভাবিক। পুরোনো পদ্ধতিতে অস্ত্রের জোরে যে প্রতিরোধের নতুন ধরনকে মোকাবিলা করা যাবে না, তা তারা জানে না। তারা প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের মধ্যে পার্থক্য করতে জানে না। প্রতিদিন কাশ্মীরিদের যে নিপীড়ন ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, কোনো ভাষাতেই তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবেই এসব তাদের হাবভাবকে কঠিন করে দিয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রায় প্রতিদিন একজন নিহত হতে দেখতে থাকায় তাদের মনোভাব এমন হয়েছে। এ ক্ষোভ প্রশমনের জন্য প্রতিবাদের যেকোনো উপায় তারা বেছে নেবেই। কোনো হুঁশিয়ারি বা ভীতি তাদের টলাতে পারবে না।
মূল প্রশ্ন হলো, সেই রোডম্যাপ, সেটাই সমাধান। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে জম্মু ও কাশ্মীরকে যে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তা মানতে চায় না। কাশ্মীর ভারতকে তিনটি ক্ষমতা দিয়েছে: প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ। (১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের মহারাজার অনুরোধে ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে। তখন থেকে কাশ্মীর ভারতের অংশ এবং কাশ্মীরিরা ভারতীয় নাগরিক—অনুবাদক) কেন্দ্র যদি আরও ক্ষমতা চায়, তাহলে তা কাশ্মীরের কাছে চাইতে হবে। নয়াদিল্লি নিজে নিজে ক্ষমতা নিয়ে নিতে পারে না। অন্তর্ভুক্তির সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করার পর ভারত যেসব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, তা শ্রীনগরকে (কাশ্মীরের রাজধানী) ফেরত দিতে হবে।
সত্য যে, সফরের সময় সাংসদেরা যেখানেই গেছেন, সেখানেই আজাদির দাবি শুনেছেন। এতে কেউ কেউ বিরক্তও হয়েছেন। আজাদি বা স্বাধীনতা শব্দটি কাশ্মীরিদের হতাশা ও মরিয়াপনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন হলো কাশ্মীরিরা আর পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা বলে না। তারা যুক্তি দেয় এবং তারা বিশ্বাসও করে যে ভারতের ‘শোষণ-শাসনের’ মুখে তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। তাদের বিশ্বাস, পাকিস্তান ও ভারতের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়াই সবচেয়ে ভালো সমাধান। আজাদি মানে মুক্তি, অপশাসন থেকে রেহাই। আজাদি শব্দটি আবশ্যিকভাবে সব সময় সার্বভৌমত্বের কথা বলে না। এখানেই ভারতের আশা নিহিত রয়েছে।
দিল্লির সমঝোতাকারীদের শ্রীনগরের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দেওয়া স্মারকলিপি পড়তে হবে। সেখানে ‘আজাদি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু কাশ্মীরিরা কী অবস্থা পার করছে, তা সেখানে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছে। স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে: ‘সশস্ত্র বাহিনীকে যেভাবে নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা ও পঙ্গু করার সর্বসময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, দেওয়া হয়েছে যেকোনো অপরাধের বিচার থেকে দায়মুক্তি, জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ তা মেনে নেবে না। বিপুল সেনার উপস্থিতির জন্য জনগণের আত্মিক, শারীরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রগুলো চরমভাবে সংকুচিত হয়ে আছে।’
দেরিতে হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজ্য সরকারকে গত তিন মাসে আটক সব রাজবন্দীসহ তরুণদের মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। মিথ্যা ক্রসফায়ারে মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদেরও চিহ্নিত করতে হবে। একই সঙ্গে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীকেও নিরীহ তরুণদের হত্যার জবাবদিহি করতে হবে।
সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ি তদন্তের জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন পাঠালে কাশ্মীরিদের মধ্যে বিশ্বাস ফিরে আসতে পারে। শ্রীনগর ও দিল্লির মধ্যে সমঝোতা আনতে হলে ইসলামাবাদকেও জড়িত করতে হবে। তাদের ছাড়া টেকসই সমাধান হয়তো সম্ভব না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.