বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪২৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মাসরুর-উল-হক সিদ্দিকী, বীর উত্তম কৌশলী এক যোদ্ধা ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। সে সময় একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন নড়াইল জেলায়। তাঁদের নেতৃত্বে মাসরুর-উল-হক সিদ্দিকী (কমল সিদ্দিকী)।


তিনি খবর পেলেন, ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনের ডিজেল প্রায় শেষ হওয়ার পথে। ঈদের দিন পাকিস্তানিরা নড়াইল থেকে সেখানে ডিজেল নিয়ে যাবে।
গোপালগঞ্জ জেলা সদর থেকে উত্তরে মধুমতী নদীর তীরে ভাটিয়াপাড়া। নদীর ওপারে নড়াইল জেলা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। এই ক্যাম্পে ছিল সেনা, মিলিশিয়া ও পুলিশের সমন্বয়ে ৪০ জনের একটি দল।
বাংকার নির্মাণ করে তারা সেখানে অবস্থান করছিল। এক বাংকার থেকে আরেক বাংকারে যাওয়ার জন্য ছিল সুড়ঙ্গপথ। প্রতিরক্ষা ছিল খুবই মজবুত। এর আগে গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার সেখানে আক্রমণ করেছেন। কিন্তু তাঁরা পাকিস্তানিদের তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেননি।
তখন ওই ওয়্যারলেস স্টেশনের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা ছিল জেনারেটরের মাধ্যমে। জেনারেটর চালানোর জন্য প্রয়োজন হতো ডিজেলের। পাকিস্তানিরা কিছুদিন পরপর ডিজেল আনত ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ বা নড়াইল থেকে।
মাসরুর-উল-হক সিদ্দিকী সিদ্ধান্ত নিলেন, পাকিস্তানিরা যখন ডিজেল নিয়ে যাবে, তখন আক্রমণ করবেন। নড়াইল থেকে তারা আসবে সড়কপথে। পথে ছোট নবগঙ্গা নদী পার হয়ে তারপর মধুমতী নদী। এই নদী পার হতে হবে গানবোটে।
মাসরুর-উল-হক সিদ্দিকী সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঈদের আগের রাতে অবস্থান নিলেন নবগঙ্গার পাড়ে। নভেম্বর মাসের ১৯ বা ২০ তারিখ। ভোর হয় হয়, এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছয়টি জিপ আসছে। তিনি সহযোদ্ধাদের বলেছিলেন, তাঁর সংকেতের আগে কেউ যেন গুলি না ছোড়েন।
কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা উত্তেজনায় আগেই গুলি করে বসলেন। পাকিস্তানিরা দ্রুত জিপ থামিয়ে আড়ালে পজিশন নিয়ে আক্রমণ শুরু করল। নিমিষে শান্ত এলাকা পরিণত হলো রণক্ষেত্রে। যুদ্ধ চলতে থাকল।
পাকিস্তানি সেনারা সবাই অবস্থান নিয়েছে জিপের আড়ালে। মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে তাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। এ অবস্থায় মাসরুর-উল-হক যুদ্ধকৌশল পাল্টালেন।
এরপর তাঁরা গুলি করতে থাকলেন পাকিস্তানি সেনাদের মাথা দেখে। এই কৌশলে বেশ কাজ হলো। তাঁদের হাতে একের পর এক পাকিস্তানি সেনা নিহত বা আহত হতে থাকল। এভাবে যুদ্ধ চলল প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টা। তারপর পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেল।
সেদিন যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটজন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন গ্রামবাসী শহীদ হন।
মাসরুর-উল-হক সিদ্দিকী ১৯৭১ সালে ওয়াপদার (বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড) সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারতে যান। সেখানে তিন মাস বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে প্রশাসনিক কাজে যুক্ত থাকেন। এরপর পুনরায় যোগ দেন সশস্ত্র যুদ্ধে। প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণ নিয়ে যশোর, নড়াইল ও ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে গেরিলাযুদ্ধ করেন।
১৮ বা ১৯ ডিসেম্বর ভাটিয়াপাড়ার যুদ্ধে তিনি আহত হন। তাঁর চোখে গুলি লাগে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ভাটিয়াপাড়ায় অবস্থানরত পাকিস্তানিরা তখন আত্মসমর্পণ করেনি। সেদিন যুদ্ধের পর তারা আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মাসরুর-উল-হক সিদ্দিকীকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৬৭। তিনি কমল সিদ্দিকী নামে পরিচিত।
মাসরুর-উল-হক সিদ্দিকী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নড়াইল জেলার সদর উপজেলার হবখালী গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন ঢাকায় (মহুয়া অ্যাপার্টমেন্ট, ১৬৭ পশ্চিম ধানমন্ডি)। তাঁর বাবার নাম জেড আহমেদ। মা ওয়াজেদা আহমেদ। স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া সিদ্দিকী। তাঁদের দুই মেয়ে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮ এবং রাফিয়া চৌধুরী।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.