গোধূলির ছায়াপথে-রুমির বাগানে মহাত্মা গাঁধী by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

এলাহাবাদ কোর্টের রায় বেরিয়েছে। মসজিদ ও মন্দির দুটিই থাকবে। ২৯ সেপ্টেম্বর রুমির ও ২ অক্টোবর গাঁধীর জন্মদিন। রুমির মসনবি আজ পৌঁছেছে সবার কাছে। ১৯০৭ সালের বসন্তে লন্ডনের একটি পত্রিকার কলামে বের হতো হ্যাডলান্ড ডেভিসের সাপ্তাহিক বক্তব্য: ‘পূবের জ্ঞানসমুদ্র’।


মাওলানা জালালউদ্দিন রুমিকে নিয়ে এই লেখাগুলো একত্র করে প্রথম পুস্তকটি প্রকাশ করেন একজন জন মেরি। সম্পাদকের আশা ছিল, পূব ও পশ্চিমের জ্ঞানকে একই আবর্তে আনলে মানুষ আসবে কাছাকাছি, দূর করবে তা সংশয়ের কালো মেঘ। ‘মেলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে’।
মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধী, বিলেতফেরত ব্যারিস্টার, জোহানেসবার্গে কর্মরত। কোনো বইয়ের দোকান থেকে সংগ্রহ করেছেন বইটি। গাঁধী অভিভূত। তখন সম্পাদনা করছেন নিজ পত্রিকা, ইন্ডিয়ান ওপিনিয়নস। আত্মার পবিত্রতা ও ঈশ্বরপ্রেম যার প্রেমফসল, সেই রুমি গাঁধীর অনুপ্রেরণা। গাঁধী রুমিকে উদ্ধৃত করে লিখছেন: ঈশ্বরকে খুঁজতে গেলাম ক্রুশ ও খ্রিষ্টানদের কাছে, মন্দিরে। হেরাটে, কান্দাহারে, পর্বতে, গুহায়—কোথাও তিনি নেই। অবশেষে জানলাম তাঁর অবস্থান নিজ হূদয়মন্দিরে, শুধু সেখানেই, অন্য কোথাও নয়। লিখছেন প্রবন্ধ শেষে: রুমি পড়ার জন্য আহ্বান জানাই, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, যা পড়ে অন্তরের ময়লা সাফ হবে।
পৃথিবী বদলেছে, পুরোনো বিভক্তিগুলো বদলায়নি। দাঙ্গা শেষ হয়েও হয়নি, মনের দাঙ্গা চলছেই। হিন্দু-মুসলমান বিরোধ রাজনীতিকে করেছে কলুষযুক্ত। লালকৃষ্ণ আদভানির রক্তরঞ্জিত রথযাত্রা ও পথ মন্দিরের চাবি খোলার ২৪ বছর অতিক্রান্ত, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ১৮ বছর অতিক্রান্ত। ‘কে আর হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’?
আমাদের আছে রুমি, আছে গাঁধী। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর পত্রপত্রিকায় কলামিস্টদের অসংখ্য বক্তব্য। একজন গাঁধীভক্ত লিখছেন: মন্দিরে যা পাইনি তা পেতে পারি ‘রাম রহিম দরওয়াজা’য়। এমন প্রার্থনালয়ে প্রবেশ করতে চাই, যেখানে আমি মানুষ, বিভক্তি ভুলে পাঠ করব গীতা, বাইবেল, কোরআন, ত্রিপিটক। আমি আমেরিকায় গিয়ে পেয়েছি বাহাইদের প্রার্থনালয়। সেখানে নামাজ পড়েছি। যেখানে মূর্তি নেই, কিয়োটোর বৌদ্ধ বিহারে, প্রভুর মুখোমুখি। প্রভুকে পেলেই সব সমস্যার সমাধান। মুসলমানেরা যেকোনো স্থানে তাই জায়নামাজ বিছাতে পারেন। প্রয়োজন নেই আকবরের ‘দ্বীন ই ইলাহি’র, প্রয়োজন দ্বীন ও ইলাহির উপলব্ধি।
আজ ত্রয়োদশ শতাব্দীর রুমিকে টাইমস লিটারেরি সাপ্লিমেন্ট সম্বোধন করছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আধ্যাত্মিক কবি হিসেবে। মহাত্মা গাঁধী যাত্রাপথে রুমিকে আর কোথাও স্মরণ করেছিলেন কি না জানা যায় না। তবে আল্লামা স্যার আবদুল্লাহ আল মামুন আল সোহরাওয়ার্দী সংকলিত নবীর সেয়িংস অব মুহাম্মদ (সা.) সংকলনগ্রন্থের ভূমিকায় মহাত্মা গাঁধী একই কথা বলেছেন, তারিখ: কলিকাতা ২৪.০৩.১৯৩৮। লিখছেন: ‘নবীর বাণীগুলো পাঠ করেছি আগ্রহের সঙ্গে, যা আমার জীবনের সঙ্গে গ্রথিত। এগুলো মুসলমানদের জন্য শুধু নয়, সমগ্র মানবমণ্ডলীর জন্য মহামূল্যবান। এগুলোর অধ্যয়ন বাড়াবে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও মূল্যবোধ।’ নবীকে মহাত্মা গাঁধী ভালোবাসতেন। রুমির সুন্দরতম চয়ন মুহাম্মদ (সা.)-এর সামগ্রিক জীবন ও কোরআন থেকে। অধম বইটির অনুবাদ করেন মুহাম্মদের বাণী (সা.) নামে ১৯৯৯ সালে। লক্ষাধিক কপি বিতরিত। ‘রুমির অলৌকিক বাগানে’র ছত্রেও হূদয়মন্দিরেরই অন্বেষা।
সাংবাদিক রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘পলিটিকস অ্যান্ড প্লে’ প্রবন্ধে লিখছেন: তুলসী দাসের পর মহাত্মা গাঁধীর মতো রামভক্ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তিনি আর কোনো মন্দিরে প্রবেশ করার সুযোগ নেননি। মাওলানা রুমির কথাটি তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল।
পৃথিবীর মুসলিম-অধ্যুষিত দেশের মধ্যে তৃতীয় আমরা। দুই লাখেরও বেশি মসজিদ যে দেশের গ্রাম-বন্দরে, মসজিদ ভালোবাসে তারা। কখনো চায় না মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য প্রার্থনালয় ভেঙে ফেলা হোক। এই রায় নিয়ে এসেছে ‘সমঝোতার সুযোগ’ (স্বপন দাশগুপ্ত)। সিদ্ধার্থ ভারাদারাজন লিখেছেন: ‘যুক্তির নয়, বিশ্বাসের জয়’। প্রথম আলো সম্পাদক লিখছেন: ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ উন্মুক্ত হলো।
কারও মতে, এখানে তৈরি হতে পারে মানবতার একটি নতুন তাজমহল, একটি হাসপাতাল। রুমির আত্মা হয়তো এতেই তৃপ্তি পেত। কোনিয়াতে দেখে এসেছি, তাঁর সমাধি ও মসজিদ সবার জন্য উন্মুক্ত।
মদন বাউল গেয়েছেন: ‘তোমার পথ ঢাইকাছে মন্দিরে মসজিদে’
অধম বলছে: দোয়া কবুল সেদিনই (মুনাজাত ই মকবুল) হবে,
যেদিন হূদয় ও মসজিদ পাবে অভিন্নতা।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.