প্রশাসন-দলীয়করণ ও যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্ন by মোহীত উল আলম

গত ২০ সেপ্টেম্বর একটি কর্মসূচি উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে ১৩ হাজার ৩৫০টি পদে দলীয় লোক নিয়োগ দেওয়া হবে সূচক (সূত্র: প্রথম আলো ও অন্যান্য জাতীয় পত্রিকা) বক্তব্য দিয়ে বিতর্কের অবতারণা করেছেন।


সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, এর ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ‘মেধার ভিত্তিতে লোক নিয়োগ করা হবে’ হালকা হয়ে গেছে। উপদেষ্টা পরে প্রথম আলোর ২৪ সেপ্টেম্বর ইস্যুতে একটি বার্তায় বলেন, তাঁর বক্তব্য গণমাধ্যম ভুলভাবে প্রচার করেছে, আবার তার পিঠাপিঠি পত্রিকাটি তাঁর ধারণকৃত ভাষ্য ছাপিয়ে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, আসলে তিনি কী বলেছেন। আবার ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় রিপোর্ট দেখলাম, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকির উপদেষ্টা সাহেবের বক্তব্যকে সমর্থন করে কোথাও যেন ভাষণ দিয়েছেন।
আমরা বিষয়টি আলোচনায় আনছি এ জন্য নয় যে উপদেষ্টা বনাম গণমাধ্যমের মধ্যকার বিরোধের মধ্যে আমরা কোনো আলোচনার বীজ খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু এ জন্য যে দলীয় লোক নিয়োগ ও যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্নটি জাতীয়ভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এর বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যাচাই করার লক্ষ্যে আমি আলোচনাটির অবতারণা করছি। অর্থাৎ, উপদেষ্টা বনাম গণমাধ্যমের বিতর্কে অংশ নিচ্ছি না, কিন্তু প্রাসঙ্গিক বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় নামতে চাই।
ফিদেল কাস্ত্রোর যে একটি উপদেশ বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেননি, কিন্তু করলে ভালো করতেন, সেটি ছিল, রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে যেন মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর বক্তব্য ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞতা কম থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্পিরিট ও দেশপ্রেমের টানে তাঁরা অভিজ্ঞতার খামতিটা পুষিয়ে নিতে পারবেন। অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা বাঙালি সিভিল এবং মিলিটারি অফিসাররা তাঁদের চিরাচরিত ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার্থে কাজ করবেন, দেশের জন্য কাজ করবেন না। কাস্ত্রোর এই উপদেশ পরবর্তী সময়ে অমোঘ সত্যরূপে প্রতিভাত হয়। (সূত্র: অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাস, বাংলাদেশ: আ লিগাসি অব ব্লাড)।
কাস্ত্রোর এ চিন্তার আলোকে দেশ পরিচালনায় একটি রাজনৈতিক সরকারের কাঠামোতে দলীয় লোক নিয়োগের প্রশ্নটি একেবারে অবান্তর নয়। বস্তুত, নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে লোক নিয়োগের সময় সরকারের পক্ষে দলীয় লোক নিয়োগ দেওয়ার রেওয়াজ খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ভারতে পর্যন্ত বিদ্যমান। স্বাভাবিক কারণে বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এ প্রবণতার একটি বাস্তব যুক্তি হলো, দলীয় লোক বা দলীয় আদর্শের সমর্থক নন, কিন্তু খুবই যোগ্য লোক, তাঁকে উঁচু পদে বসিয়ে রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে কাজ চালানো সম্ভব নয়। কারণ, শাসনব্যবস্থার উপরিভাগে সবকিছুর ওপর প্রয়োজন পড়ে ট্রাস্ট বা আস্থা। নেতার প্রতি, দলের প্রতি ও আদর্শের প্রতি। ব্রিটেনের রানি প্রথম এলিজাবেথ যে তাঁর সম্ভাব্য প্রেমিক রাজসভার দেদীপ্যমান সদস্য আর্ল অব এসেক্সকে গিলোটিন করেছিলেন, তার পেছনে মন্ত্রণা ছিল রানির একান্ত বিশ্বাসযোগ্য অমাত্য মুখ্য সচিব স্যার রবার্ট সেসিলের। কথিত আছে, এ সেসিলকে রানি একবার রেগে গিয়ে রাজসভায় প্রকাশ্যে চড় মেরেছিলেন, কিন্তু তাতেও সেসিলের আনুগত্য এতটুকুও টাল খায়নি। রবার্ট সেসিল ও তাঁর বাবা ব্যারন উইলিয়াম সেসিল এবং তাঁর আগের মুখ্য সচিব স্যার ফ্যান্সিস ওয়ালশিংগাম ছিলেন ইংরেজ আমলাতন্ত্রের পুরোধা: রাজ্য পরিচালনায় রানিকে/রাজাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার যেমন তাঁদের ছিল অপরিসীম দক্ষতা, তেমনি তাঁদের পেশাগত জীবনের সাফল্যের ভিত্তি ছিল নৃপতির প্রতি শর্তহীন আনুগত্য। (সূত্র: গ্রাহাম হোল্ডারনেস: শেকসপিয়ার: দ্য হিস্ট্রিজ)।
বর্তমান যুগেও সেসিল-ধরনের আনুগত্য যে দেখা যায় না, তা নয়; কিন্তু আমাদের আলোচনার জোরটি পড়ছে আনুগত্য ও যোগ্যতার সম্পর্ক নির্ধারণে। কাস্ত্রোর কথায় আবার ফিরে আসি। তিনি আনুগত্যের কথা বলেছিলেন, তাও যোগ্যতার কথা স্বীকার করে নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভ্রান্ত যোগ্যতা। মুক্তিযোদ্ধারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে সদ্য অর্জিত স্বাধীনতাকে যে পরিপুষ্টি দিতে পারতেন, সেটি তো অন্যদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এটি হয়নি বলে দেশ ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে, ক্ষয় হয়েছে একের পর এক মুক্তিযোদ্ধার।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে, বিশেষ করে, ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে বিপাকে পড়ে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরামহীন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলিস্বত্বসহ বিভিন্ন আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দেন। তার পরও ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দৌরাত্ম্য হ্রাস না পেলে বলা হয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছাত্রলীগ বা যুবলীগের আর সাংগঠনিক সম্পৃক্ততা থাকবে না। বস্তুত, পাবনার সাম্প্রতিক ঘটনায়—যেখানে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় হামলা হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিরোধ তৈরি হয়েছে, সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা তৈরি করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম গেলে তাঁকে যখন জানানো হয় যে হামলাকারীরা ছিল সরকারদলীয় বিভিন্ন সংগঠনের, তখন তিনি জানান, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগের অংশ নয়, তারা গন্ডগোল করে থাকলে সে দায়িত্ব সরকার নেবে না।
কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। আওয়ামী লীগ (বা একই কারণে বিএনপি) চাইতে পারে না যে ছাত্রলীগ বা যুবলীগ (বা ছাত্রদল বা যুবদল) তাদের থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত থাক। এটা তারা সরকারিভাবে বললেও বাস্তবে সেটা কার্যকর হবে না। কারণ, ইয়ুথ টিম না থাকলে যেমন জাতীয় ক্রিকেট বা ফুটবল টিম তৈরি হতে পারে না, সে রকম ছাত্র ও যুবক থেকে কর্মী উঠে না এলে বড় দল সংগঠিত হতে পারে না। এ জন্যই এডাল্ট দলগুলোর ইয়ুথ দলের দরকার হয়। এ প্রয়োজনটা আওয়ামী লীগের জন্য (বা বিএনপির জন্য) একটি অতিশয় বাস্তব প্রয়োজন।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামোগত দর্শন যদি আমরা কিছুমাত্র বুঝতে পারি, তাহলে বুঝতে পারব, কেন হাজার হাত শক্তিশালী হয়েও সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষে ছাত্রলীগ বা যুবলীগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আসলে সম্ভব হচ্ছে না, তা নয়; বাস্তব কারণে তা চাওয়াও হচ্ছে না। কেন? তার কারণ, দলীয় রাজনীতির একটি শক্তিশালী খুঁটি হচ্ছে জনসমর্থন, আর আরেকটি খুঁটি হচ্ছে আধিপত্যবাদ। সমর্থন বলতে বোঝায় যেমন ভোট পাওয়া, কোনো ইস্যুতে নাগরিকদের সমর্থন পাওয়া, গণমাধ্যমের সমর্থন ইত্যাদি। কিন্তু আধিপত্যবাদে সমর্থনটা জোর করে আদায় করা হয়। অথবা সমর্থন আদায় করতে না পারলে জোর করে আধিপত্য বজায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি দলের পক্ষে পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য আইন নিয়ন্ত্রণী সংস্থা আছে, যাদের দিয়ে সরকার সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা রকম শৃঙ্খলা বজায় রাখে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাজে শুধু পুলিশ বা আনসার দিয়ে কর্তৃত্ব বা আধিপত্য বজায় রাখা যায় না। জনগণ ও গণমাধ্যমের নির্মাংসল সমর্থন দিয়েও কর্তৃত্ব বা আধিপত্য বজায় রাখা যায় না, এ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে দরকার হয় আধিপত্যবাদী শক্তি। এ আধিপত্যবোধ রাজনৈতিক চেতনার বহু গভীর শিকড় থেকে প্রস্রবিত হয়, যার প্রধান উৎস অর্থনৈতিক। কারণ, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে হয়। এ পুরস্কারের ব্যবস্থা যেমন রাস্তায় থাকতে হবে, তেমনি থাকতে হবে সেতুর ওপর টোল গ্রহণের মাধ্যমে, তেমনি থাকতে হবে গরুর হাটে, চামড়ার বাজারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজে, বাসের ডেরায়, রেলস্টেশনে, আড়তে, বাজারে, মাছঘাটে, টেন্ডারে, কেব্ল ও ভিডিওর বাজারে, এমনকি পাড়ার সুন্দরী মেয়েদের ওপর। এসব ক্ষেত্রে পেশির ভূমিকা ব্যাপক। এ পেশি সরবরাহ করে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং স্কুল ও পাড়ার দলীয় তরুণ ও যুবকেরা। এ পেশিশক্তিকে সন্তুষ্ট রাখতে ক্ষমতাধারী দলকে নানা রকম পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে হয়। সে জন্য সরকারি দল বা বিরোধী দল নিজেদের যুবশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, বা চায় না। সরকারি দলের মনে ভয় থাকে, যদি এ তরুণ-যুবক শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়, তাহলে বিরোধী দলগুলোর তরুণ ও যুবক সংগঠনগুলো সে অঞ্চলগুলো দখল করে নেবে। দখল করে নিলে বণ্টনকৃত পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে না, তখন আধিপত্য খর্ব হবে।
আধিপত্যবোধের এ চেতনা থেকে উপদেষ্টা সাহেব (সম্ভবত মুখ ফসকে) বলে ফেলেছেন, সব কমিউনিটি ক্লিনিকের পদ দলীয় লোকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। নিরেট বাস্তবতা। কিন্তু ওইভাবে বলাটা কৌশলী বলা হয়নি। আর যোগ্যতা? পেশির নিছক যোগ্যতা পেশিই।
তবে আমার একটা প্রিয় রচনা আছে তপনকুমার রায়চৌধুরী প্রণীত সেকাল ও একাল, যেটার বহু উল্লেখ আমি বহু কলামে করেছি, এবং প্রাসঙ্গিক বিধায় আজও করছি। তিনি কংগ্রেসের স্বাধীনতালগ্নের রাজনীতির সঙ্গে বর্তমান কালের কংগ্রেসের রাজনীতির প্রভেদ দেখাতে গিয়ে বলেছিলেন, তখন কংগ্রেস (এবং মুসলিম লীগও) একটা পদ্ধতিতে কর্মী জোগাড় করত। কংগ্রেসের কয়েকটা ছোট ছোট সেল বা বিশেষ দল ছিল, যাদের কাজ ছিল সারা ভারত চষে মেধাবী, গুণবান (গুণবতী), সচ্চরিত্রের তরুণ সদস্য-সদস্যা সংগ্রহ করা। কিন্তু কংগ্রেসের সে ধারা রক্ষিত হয়নি, এবং রায়চৌধুরীর মন্তব্য (স্মরণ থেকে লিখছি), ‘এখন ভারতীয় সংসদে এমন অনেক সদস্য আছেন, যাঁরা সংসদে না বসে জেলে থাকার যোগ্য।’
আধুনিক রাজনৈতিক সমাজ বহু পরস্পরবিরোধী বিপরীত চক্রে আবর্তিত একটি জটিল প্রক্রিয়া, তাই দলীয়করণের সঙ্গে যোগ্যতা, অযোগ্যতার সম্পর্কটি সরলীকরণভাবে দেখার উপায় নেই।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয়প্রধান, ইংরেজি ও মানববিদ্যা বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.