দুর্ঘটনা নয়, সার্বিক দায়িত্বহীনতার গণখেসারত-রেলক্রসিংয়ের মৃত্যুফাঁদ

ট্রেন-বাস এক পথে চলে না, তাই তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটার আশঙ্কা অতিসামান্য। তাহলেও উভয় যানের গতিপথ স্থানে স্থানে পরস্পরকে কাটাকুটি করে যায় বলে সেই স্থানগুলোতে বিপদের একটা ঝুঁকি থাকে। এই ঝুঁকি এড়াতেই অধিকাংশ রেলক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধক বসানো থাকে এবং তা কার্যকর করার জন্য একজন লাইনম্যানও থাকেন।


সুতরাং, ট্রেন ও বাসের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ার সুযোগ খুবই কম এবং তা ঘটলে তাকে দুর্ঘটনা বলার সুযোগ আরও কম। তাই রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল-সংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে গত বুধবারের সংঘর্ষকে পরিষ্কারভাবে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের গাফিলতির ফল হিসেবেই দেখতে হবে।
ট্রেন রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় রেলগেটে প্রতিবন্ধক থাকবে, এটাই ট্রেনচালকের জানার কথা। লাইনম্যানেরও ট্রেন আসার সময়টি জানা ছিল এবং সময়মতো প্রতিবন্ধক নামিয়ে অন্য যান চলাচল বন্ধ করার দায়িত্বটি একান্তই তাঁর। রেলক্রসিংয়ের কাছে আসার সময় সব ধরনের সড়কযান ও পথচারীদেরও সাবধানতা অবলম্বনের কথা। কিন্তু সায়েদাবাদ রেলক্রসিংয়ে সেদিন কেউই কথা রাখেনি; দায়িত্ব পালন করেনি। তারই খেসারত হিসেবে ১৩ জন আহতসহ এ পর্যন্ত ছয়জনের জীবনহানি ঘটেছে।
লাইনম্যানের দায় এড়ানোর উপায় নেই। কিন্তু যে বাসগুলো ট্রেন আসার সময় রেললাইনের ওপর উঠে আটকে গিয়েছিল, তার চালক ও সহকারীরাও কি সম্পূর্ণ দায়মুক্ত? ট্রেন আসার কোনো আলামতই কি তাঁরা পাননি? আর তাঁরা যদি সবাই দুর্ঘটনারই শিকার হন, তাহলে একযোগে বাস দুটির চালক ও সহকারী, ট্রেনের চালক এবং লাইনম্যান পালিয়ে গেলেন কেন? ঘটনার পেছনে প্রত্যক্ষ দায়ের পাশাপাশি পরোক্ষ দায়গুলোও তাই চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন।
জনসংখ্যার ভারের তুলনায় কম সড়ক, কম গণপরিবহন, দুর্বল নগর ও সড়ক ব্যবস্থাপনাও এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জমিন তৈরি করে রাখে। পাশাপাশি বাসচালকদের অসাবধানী চালনা, যাত্রীদের মধ্যেও আগে পৌঁছানোর তাড়নায় চালকদের প্ররোচিত করার প্রবণতাও কম নয়। পথচারীদের অসাবধানতা তো হরহামেশাই দেখা যায়। সবকিছু নিয়মানুগভাবে চলছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব যেসব সংস্থা ও ব্যক্তির, তাঁদেরও গাফিলতি আছে। সব মিলিয়ে, যেকোনো সময় যেকোনো সড়কে ছোট-বড় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার মতো পরিস্থিতি বিদ্যমান। এই বাস্তবতা নিজেই এক গণবিধ্বংসী আশঙ্কা, যেখানে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা মানুষ হারিয়ে ফেলে।
বহুদিন হলো রাজধানীর ভেতরের রেলক্রসিংগুলো সড়কযাত্রীদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে রয়েছে। উড়ালপথ নির্মাণ করে, অথবা রেলপথ অন্যত্র সরিয়ে বা অন্য কোনো বিশেষ উপায়ে এর সমাধান সম্ভব। কিন্তু তা নিয়ে কেবল আলোচনাই হচ্ছে; ওদিকে ঘটছে একের পর এক মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে তাই নিজেদের ভূমিকার মূল্যায়ন করে প্রতিকারে হাত লাগানো উচিত। অহেতুক এভাবে মানুষের জীবনহানি ঘটতে থাকা চলতে পারে না। যদি চলে, তাহলে বুঝতে হবে, ব্যবস্থার জায়গায় অব্যবস্থাই কায়েম আছে।

No comments

Powered by Blogger.