কিশোর ভিমানি-সাদা পোশাকের ক্রিকেট কূটনীতি

১৯৭৮ সালে উত্তর ভারতের উষ্ণ শরৎকালের কথা। ক্রিকেটপ্রেমীদের ক্ষমা করতে হবে, যদি জানতে চাওয়া হয়, তখনকার সেই ক্রিকেট সফর ক্রিকেট বোর্ডের ছিল, নাকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছিল। বহুকাল পর, বিশেষ করে ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর তখন ভারতীয় ক্রিকেট দল পাকিস্তান সফরে গিয়েছিল।


পাকিস্তানে সব কিছু তখন জেনারেল জিয়ার নিয়ন্ত্রণে। সন্ত্রাস নামের বস্তুটি তখন উপমহাদেশে ছিল অপরিচিত। তখন পর্দার আড়ালে নেগোসিয়েশন চলছিল। সাধারণ ভারতীয়রা মনে করেছিল, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের পেছনে আইএসআই লেগে ছিল। তখন মহারাজা ফতেহ সিং গায়কোয়াড়কে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বরোদার 'জ্যাকি' ক্রিকেট সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতেন না। কিন্তু ছিলেন পাকিস্তানের পুরনো দোসর। বলা হয়, ১৯৪০-এর দশকে যখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল, তখন তিনি শত শত মুসলমানকে প্রাসাদে মানবিক আশ্রয় দিয়েছিলেন। স্থানীয় পত্রিকাগুলো নিশ্চিত করেছিল যে করাচি ও লাহোর এ বিষয়টি জানত।
রাজা ছিলেন ভালো একজন অভিনেতা। তিনি ম্যানেজার হিসেবে ভাষণ দিতে গিয়ে অশ্রুসজল চোখে বলেছিলেন, 'রোনা আতা হ্যায়' (আমার কান্না পাচ্ছে)। তিনি মহাকবি ইকবালের চরণ আবৃত্তি করেছিলেন, 'সারা জাঁহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্তান হামারা।' হিন্দুস্তান মানে অবিভক্ত ভারত।
তখন ভিসা পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু নিজেকে ক্রিকেট লেখক বলায় সব কিছু সহজ হয়ে যায়। তখন শীর্ষপর্যায়ের রাজনৈতিক নিবন্ধকাররাও গিয়েছিলেন। যদিও তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, 'সেকেন্ড স্লিপ' হলো বাংলাদেশ যুদ্ধ আর 'এঙ্ট্রা কাভার' হলো স্থলবাহিনীর এয়ার কাভার। আমাদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল পাঞ্জাবের চিপ মিনিস্টার শওকত ঘোরায়া, বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নূরজাহান এবং টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আনোয়ার মাকসুদের মতো সেলিব্রিটিদের বাড়িতে। পাকিস্তানের প্রবাদসম গজলশিল্পী মেহেদি হাসানের কথা জানতে চাওয়ায় ভারতীয় দলের জন্য দ্রুত একটি কনসার্টের ব্যবস্থা করা হয় পাকিস্তানের দিলীপ কুমার হিসেবে পরিচিত মাহমুদ আলীর প্রাসাদোপম বাড়িতে।
হারমোনিয়ামের চারপাশ ঘিরে বসেছিলেন বিষেণ সিং বেদি, আম্পায়ার শাকুর রানা, ইমরান খান, অভিনেত্রী বাবরা শরিফ এবং ভারতীয় হাইকমিশনের হিমাচল সোম, যিনি সাহিওয়াল শহরে আমাদের এক বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছিলেন। মেহেদি হাসান জেনে অভিভূত হয়েছিলেন, ভারতীয় সফরকারীরা আহমেদ ফারাজ, মীর তকি মীর এবং মির্জ্জা গালিব সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল। তিনি আমাদের সব অনুরোধ রক্ষা করে গজল শুনিয়েছিলেন।
সাহিওয়ালের অভিজ্ঞতাটি ছিল তিক্ত। বিষেণ সিং বেদি এবং আম্পায়ার শাকুর রানার মধ্যে সরফরাজ নেওয়াজের একটি বাউন্সার দেওয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। বিষেণ সিং বেদি মাঠ থেকে বের হয়ে আসেন। ১০ হাজার দর্শক উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং স্লোগান দিতে থাকে, 'নারায়ে তাকবির, আল্লাহ হু আকবার', 'হিন্দুস্তান মুর্দাবাদ'।
হিমাচল সোম তখন একটি রেজিমেন্ট পেয়েছিলেন ধারাভাষ্যের বঙ্ েনিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। সেখানে মাইকে ছিলাম আমি, ওমর কুরায়শি এবং চিশতি মুজাহিদ। গায়কোয়াড় একটি মাইক্রোফোন থেকে জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখলেন। তিনি শুরু করলেন, 'মেরি দোস্তন' বলে। তিনি জনতার সঙ্গে রসিকতাও করতে চেষ্টা করলেন যে বেদি প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছেন বিশ্বনাথের সঙ্গে ব্যাট করার জন্য একজন লম্বা ব্যাটসম্যান খুঁজতে!
তিনি জাভেদ মিয়াঁদাদকে ড্রেসিং রুম থেকে নিয়ে এলেন এবং এই তরুণ ব্যাটসম্যানের হাতে হাত রাখলেন। দর্শকরা তখন শান্ত হলো।
সেই সন্ধ্যায় আমরা আমাদের ডাকবাংলোতে ফিরে এলাম। আমরা বুঝতে পারলাম কূটনীতি এবং সতর্কতা আমাদের আজ রক্ষা করেছে। কিন্তু পরের বার হয়তো আমরা এতটা ভাগ্যবান নাও হতে পারি। পাকিস্তান তখন জেনারেল জিয়ার অধীনে দ্রুত ইসলামীকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছিল।
বন্ধুত্বপূর্ণ ও বিনয়ী জহির আব্বাসের ঘর ছিল ক্রিকেটারদের জন্য অবারিত। আমরা গুলাম আলী (তাঁর মতোই একজন শিয়া) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই এই বিখ্যাত ব্যাটসম্যান তাঁর প্রাসাদোপম বাড়িতে একটি কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন।
লাহোরে একটি ঘটনা ঘটেছিল। কর্নেল আবদুর রহমান খান নিয়াজি আমাদের উদ্দেশে একটি পার্টি দিয়েছিলেন। ভারতীয় ক্রিকেটারদের সঙ্গে ইমরান, ইউনুস খান ও মিয়াঁদাদও উপস্থিত ছিলেন। সেনাবাহিনীর ডিসকাউন্ট দেওয়া অ্যালকোহলের জোয়ার বইছিল। পার্টি ছিল সেনা ক্যান্টনমেন্টের সংরক্ষিত এলাকায়। এক ডিভিশন মিলিটারি পুলিশ এসে পার্টি ঘিরে ফেলেছিল।
কলকাতার দ্য টেলিগ্রাফ থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.