পশুস্বাস্থ্য-অ্যানথ্রাক্স ও বাংলাদেশের বন্য প্রাণী by খসরু চৌধুরী

ঘাতক ব্যাধি অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ছে দেশব্যাপী। ভয় হচ্ছে এই রোগ দেশের বন্য প্রাণীতে ছড়িয়ে না পড়ে। দেশের প্রায় বিশ শতাংশ গবাদিপশু চরে বেড়ায় জঙ্গল এলাকা বা তার আশপাশে। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ বন এলাকায় গবাদিপশু অবাধে প্রবেশ করে থাকে।


ভাওয়াল, মধুপুর, শেরপুরের সীমান্তবর্তী বনেও গরু, মোষ, ছাগল ও ভেড়া ঢুকে পড়ছে। উপকূলীয় বেষ্টনীর বনভূমি তো ছাগল, গরু ও মোষের দখলেই। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের প্রায় ৪৫ কিলোমিটার (চাঁদপাই রেঞ্জ) ও ১০ কিলোমিটার শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় গ্রামবাসী নিয়মিত গরু ও মোষ জঙ্গলে ঢোকাচ্ছে।
বাংলাদেশে গৃহপালিত পশুর মাধ্যমে বন্য প্রাণী কতটা আক্রান্ত হয়েছে, সে বিষয়ে খুব একটা জানা যায় না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত-নেপাল এ বিষয়ে কিছুটা সজাগ। এ দেশগুলোর বন বিভাগ, জীববিজ্ঞানী, বিদেশ থেকে আসা জীববিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন বন্য প্রাণীর মধ্যে গাউর, বুনোমোষ, গন্ডার, বারাশিঙা হরিণ, চিত্রল হরিণ, কৃষ্ণসার অ্যান্টিলোপ, শম্বর হরিণ রোগগ্রস্ত গৃহপালিত পশুর সংস্পর্শে এসে দলে দলে মারা পড়েছে। এদের মধ্যে গন্ডার ছাড়া অন্যান্য প্রাণী দলেবলে চরা প্রাণী।
রোগের মধ্যে খুরারোগ, রিন্ডারপেস্টের আক্রমণে গাউর, শম্বর হরিণ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে প্রাণীগুলো ঝাড়েবংশে শেষ হয়ে গেছে। রিন্ডারপেস্ট গন্ডারের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। চিত্রল, বারাশিঙা, কৃষ্ণসার বিপুল হারে মারা পড়েছে অ্যানথ্রাক্সের কবলে। মায়া হরিণের কথা খুব একটা জানা যায় না। কারণ, এরা একলা বা দোকলা নিশাচর প্রাণী। আকারে ছোট। রোগগ্রস্ত হয়ে মারা পড়লে ছোট-বড় নানা শিকারি প্রাণীর খাবার হয়ে যায়। দেহাবশেষ চোখে পড়ে না। শূকরও মাঝেমধ্যে মহামারির কবলে পড়ে। তবে সেটা অ্যানথ্রাক্সের আক্রমণে হয়তো না।
বাংলাদেশে বন্য গরু ও মোষ নেই বললেই চলে। শম্বর হরিণও তেমন একটা নেই। আছে শুধু চিত্রা আর মায়া হরিণ। চিত্রা হরিণ অধ্যুষিত নিঝুম দ্বীপ ছাড়া বাংলাদেশের সব কয়টি বনে মায়া হরিণ আছে। তবে সংখ্যায় খুবই কম। সুন্দরবনের শরণখোলা, চাঁদপাই, নলিয়ান রেঞ্জের শিবশা নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত এই প্রাণীটির চারণা বিস্তৃত। এদের ডাক অনেকেই শুনে থাকবেন, তবে দেখার ভাগ্য খুব কম মানুষের হয়েছে।
এরা মূলত ব্রাউজার বা পাতাখেকো প্রাণী। এরা শেষ বিকেল থেকে রাতের প্রথম ভাগ এবং শেষরাত থেকে সকাল পর্যন্ত খাওয়ার জন্য চলাফেরা করে। কুয়াশাচ্ছন্ন অথবা মেঘমেদুর দিনে এরা কর্মচঞ্চল হতে পারে। এদের নিশাচর জীবনযাপন ও একা থাকার প্রবণতায় এরা সাধারণত বনে ঢোকা গবাদিপশুর সংস্পর্শে আসে না। ফলে রোগগ্রস্ত গবাদিপশু থেকে খুব একটা আক্রান্ত হয় না।
চিত্রল হরিণ একাধারে ব্রাউজার ও গ্রেজিয়ার অর্থাৎ পাতাও খায়, ঘাসও খায়। এরা দিবাচর, দলগত প্রাণী। তবে চাঁদনি রাতে ঘাসের মাঠে চরে বেড়ায়।
আমাদের সিলেট বিভাগের কোনো বনে চিত্রা হরিণ নেই। চট্টগ্রাম বিভাগের চুনতি, পাবলাখালী এলাকায় বন বিভাগ কিছু হরিণ ছেড়েছিল। চুনতির হরিণ স্থানীয় শিকারিরা শেষ করেছে, পাবলাখালীতে এরা তেমন ছড়াতে পারেনি; সামান্য কয়েকটি এখনো আছে। চট্টগ্রাম বিভাগে ডুলাহাজরা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের প্রজননকেন্দ্র এবং কুমিরা ও আশপাশর উপকূলীয় বনে বন বিভাগের ছাড়া সামান্য চিত্রা হরিণ আছে। নোয়াখালীর উপকূলীয় বনবেষ্টনীতে চিত্রা হরিণ ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। বন উজাড়, খাদ্যসংকট ও অবৈধ শিকারে এদের বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ। এই হরিণ অসাধারণ দ্রুততায় ছড়িয়ে পড়েছিল হাতিয়ার দক্ষিণে নিঝুম দ্বীপে। পাঁচ বছর আগে নিঝুম দ্বীপ সফরের সময় দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম অংশের বিশাল চারণভূমির মাঠটিতে ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালে প্রায় হাজার দেড়েক হরিণের বিশাল ঝাঁক দেখেছিলাম। ঘাসের মাঠটি গল্ফ কোর্টের মতো মসৃণ করে দিয়েছিল হরিণরা। দ্বীপের উত্তরে, পশ্চিমে গৈরিক সাগরে উদ্দাম উচ্ছ্বসিত জলরাশি, কাদার তীরভূমিতে তীরখুঁটা পাখির ঝাঁক, মাঠের কোণে দুই-তিন শ বদর কবুতর রোদ পোহাচ্ছে; আর পান্না-সবুজ ঘাসের মাঠে দলে দলে দিগন্ত ব্যাপ্ত করে ছড়িয়ে পড়েছে মরকত লাল হরিণের দল। সুন্দরবনের কটকা কচিখালীর ঘাসের মাঠে পাঁচ-ছয় শ হরিণের ঝাঁক, হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণের মাঠে ৪০০ হরিণের জমায়েত দেখেছি। শুনেছি ভারতের কানহা ময়দানের হরিণ জমায়েতই হলো ভারতের সবচেয়ে বড় হরিণ জমায়েত; তবে ৬০০-এর বেশি হরিণ জমে না বলে শুনেছি। সেখানে নিঝুম দ্বীপের হরিণ জমায়েত উপমহাদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।
সে সময় নিঝুম দ্বীপের জঙ্গলে ঢুকে শঙ্কিত হয়ে লক্ষ করেছিলাম, দ্বীপের ছোট ছোট কেওড়া, ওরা, গেউয়ার গাছগুলো আর বাড়তে পারছে না। ক্ষুধার্ত হরিণের পাল গাছগুলো বনসাই করে দিয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানাল, হরিণের উৎপাতে তাদের খেতখোলা মাছ ধরার জাল দিয়ে ঘিরে রাখতে হয়।
নিঝুম দ্বীপের দ্বৈপায়ন হরিণের সেই সুদিন আর নেই। পাঁচ বছর আগে নিঝুম দ্বীপে স্থায়ী বাসিন্দা ছিল ১৫ হাজার। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবী। বর্তমানে বাস করছে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। এদের অধিকাংশই কৃষিজীবী; গরু ও মোষ পালন করে। সঙ্গে নিয়ে গেছে কুকুর। গরু, বিশেষ করে মোষ এখন হরিণের জায়গা নিয়েছে। দ্বীপে নিয়ে আসা কুকুরগুলো এখন দল বেঁধে জঙ্গলে ঢুকে হরিণের বাচ্চা মেরে খায়। বন বিভাগ সূত্রে জানতে পেরেছি, তারা ১৭টি কুকুর গুলি করে মেরেছে। গত সিডরের সময় অনেক হরিণ ভেসে যায়। কিছু কিছু হরিণ উপকূলীয় বেষ্টনী বনে আশ্রয় নিয়েছে। স্থানীয় কিছু শিকারি এদের ওপর হামলে পড়ছে। মনপুরা, চর কুকরী-মুকরী, চর পাতিলায় কিছু হরিণ আছে। এ এলাকাগুলোতেও গরু-মোষ ঢোকে।
পূর্ব সুন্দরবনে চাঁদপাই থেকে নাংলী টহলফাঁড়ি এলাকার জঙ্গলগুলোয় গ্রামবাসী নিয়ত গরু-মোষ ঢোকায়। এদিকটায় জঙ্গল প্রায় লোকালয়-লাগোয়া। সামান্য একটি খাল বা ভোলা গাঙের মরা খাত পার হয়ে গরু-মোষ জঙ্গলে ঢোকে। মাঝেমধ্যে বাঘের হাতে মারা পড়ে। রাতের বেলা গরু-মোষের খোঁজে অনেক সময় বাঘও লোকালয়ে হানা দেয়। বগি থেকে শরণখোলার ভোলা নদীর সংযোগ খাল পার করে অনেক গ্রামবাসী জঙ্গলে মোষ ঢোকায়।
পশর নদীর পশ্চিম পাড় থেকে কৈখালী পর্যন্ত আমাদের বন সীমানায় গরু-মোষ ঢোকানো হয় না। তবে কোনো রোগে গরু-মোষ মারা গেছে এগুলো চামড়া ছড়িয়ে বেড়িবাঁধের জঙ্গলের দিকের ঢালে ফেলে দেওয়া হয়। জোয়ারে এগুলো ভাসতে ভাসতে জঙ্গলে পৌঁছায়।
অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ যেভাবে গৃহপালিত পশু ও মানুষে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে আশঙ্কা জাগে জঙ্গলগামী গৃহপালিত পশু থেকে বন্য প্রাণীও সংক্রমিত হতে পারে। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ! জঙ্গলগুলো খালি হয়ে যাবে। সুন্দরবনে বাঘের হাতে মানুষ মারা পড়ার ঘটনা অনেক বেড়ে যাবে। বাঘের গ্রামে ঢোকার প্রবণতাও নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে। খাদ্যাভাবে বাঘের সংখ্যাও কমে যাবে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা ও বন বিভাগকে তৎপর হওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খসরু চৌধুরী: লেখক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.