সালানিনির পিয়ানো বাদন-জিম্বাবুয়ে দিনযাপন by মঈনুস সুলতান

সালানিনি মাজাইরানার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র হচ্ছেন মি. ডেভিড জবসন। আমি তখন বুলাউয়েওর লেখওয়ানি রুরাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে কনসালট্যান্সি করছি। জবসন সাহেব এ সংস্থার ডিরেক্টর। তিনি গাত্রবর্ণে শ্বেতাঙ্গ হলেও ঠিক জিম্বাবুয়ের সাম্প্রতিক সম্পত্তি খোয়ানো পোড়া কপাল হোয়াইট নন। খাস বিলাতের লোক।


আমার ভদ্রাসন সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায়। বুলাউয়েতে আসার সময় তিনি আমাকে কিছু ওষুধপত্র ও ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য বায়োপসি নিডোল নিয়ে আসতে অনুরোধ করেছেন। এগুলোর সঙ্গে বিস্কুট, লজেন্সসহ তাঁর গাড়িতে আমি বসে আছি। জবসন বিলাতি কেতার একটি ম্যানশনের লনে গাড়ি দাঁড় করান। লনে এলোপাতাড়ি পার্ক করে রাখা ছয়-সাতটি টয়োটা হোন্ডা ইত্যাদি ঝকঝকে নতুন কার। গাড়ি থেকে নেমে মোবাইলে কাকে কিছু বলে তিনি প্রশস্ত পর্টিকোর দিকে যেতে যেতে বলেন, ‘ওয়াক স্ট্রেইট টু দি ব্যাক অব দিস ম্যানশন। পেছনের সার্ভেন্টস হাটে বায়োপসি নিডোল আর ওষুধবিসুদ দেবে। সালানিনি স্কুল থেকে পড়িয়ে এখনই ফিরবে।’ ‘আপনি আমার সঙ্গে যাবেন না?’ বলে আমি মিনমিন করলে, ‘সালানিনির ফ্যামিলির সঙ্গে তোমার ডিরেক্ট যোগাযোগ হলে তুমি তাদের হেল্প করতে পারবে। মোর অভার সি ইজ অ্যা নাইস জলি ফাইন গার্ল’ বলে তিনি পর্টিকোতে ওঠেন। ওখানে বিলিয়ার্ড টেবিলের পাশে নির্জন বারকাউন্টারে রাখা কটি পেগগ্লাস। সেখান থেকে তিনি হাত নেড়ে বলেন, ‘আমি এক হাতে বিলিয়ার্ড খেলছি, ততক্ষণে তুমি সালানিনিদের সঙ্গে কাজ সেরে আসো।’
ম্যানশনের পেছনে কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা হর্স-ক্রাল। তাতে বিচালির আঁটির সামনে অলস দাঁড়িয়ে জাবর কাটছে চারটি ঘোড়া। আমি উঠান অতিক্রম করতেই সার্ভেন্টস হাট বা শণের কুঁড়েঘরের দেখা পাই। তার দাওয়ায় হুইলচেয়ারে বসে সালানিনির বাবা ভীষণ সাদা দাঁতে হাসেন। আমি তাকে গুড আফটারনুন বললে তিনি খুব বিনয়ে ‘ইউ আর অ্যা ফাইন উমুনতা, আই মিন গুড পারসন। ভেতরে যাও মিস্টার, কথাবার্তা আমার মিসেসের সঙ্গেই বলতে হবে।’ আমি চৌকাঠে দাঁড়াতে ঘিরে ধরে পিঠাপিঠি গোটা ছয়েক আধন্যাংটা ছেলেমেয়ে। ময়লা হেডগিয়ার ও অ্যাপ্রোন পরে সালানিনির মা বেরিয়ে এসে হুইলচেয়ারে বসা তাঁর স্বামীকে অভিশাপ দিতে দিতে বলেন, ‘কত বলি, রাজসড়কে গিয়ে একটু ভিক্ষাসিক্ষা করো, পা খোয়ানো মিনসে সারা দিন এখানে বসে ঝিমুবে। আর রাত হলে উঠেপড়ে লাগবে আরেকটি বাচ্চার জন্ম কীভাবে দেওয়া যায়। মিস্টার, লুক অ্যাট, মাই অল দিস স্টুপিড আবানতওয়ান।’ তাঁর স্বামী বলেন, ‘মিস্টার ইজ অ্যান ইন্ডিয়ান, হি ডাজ নট আন্ডারস্ট্যান্ড আওয়ার সিনডেবেলে ল্যাংগুয়েজ। আবানতওয়ান মিনস চিলড্রেন। দে আর ফাইন আবানতওয়ান।’
কুঁড়েঘরের ভেতরে বেজায় অন্ধকার। গাছের গুঁড়ির ওপর আমি বসলে মিসেস ফিসফিস করে বলেন, ‘মাই হাজব্যান্ড ইজ নো স্টুপিড অ্যাট অল। কিন্তু রাজনীতিই তার কাল হলো। সে জাপু পার্টির ভেতরের লোক। আমরা যারা নেডেবেলে—আমাদের গোত্রের পার্টি হচ্ছে জাপু। আর মাসোওনা সম্প্রদায়ের পার্টি জানুপিএফ। রবার্ট মুগাবে বেঁচেবর্তে ক্ষমতায় তড়পাচ্ছে বলেই তাদের এত রবরবা। আমার হাজব্যান্ডকে কিডন্যাপ করে না খাইয়ে রাখে সপ্তাহ দিন। তারপর পাথর জোগাড় করে, প্রজননের যে প্রত্যঙ্গ তা স্মাশ করবে বলে। জানুপিএফের ক্যাডাররা ছিল ড্রানক। এখন যে খোঁড়াকে হুইলচেয়ারে দেখছ, যিশুর কৃপায় হঠাৎ করে তার শরীরে এসে যায় খোদাই তাকদ। সে চারজন ক্যাডারের সঙ্গে একা ধস্তাধস্তি করে সাভানার দিকে ছুটে পালায়। তারা পেছন থেকে গুলি করে। পা ও কোমরে দুটি গুলি নিয়ে সে পালিয়ে আসে। হি ইজ নো স্টুপিড ম্যান।’
মিসেসের শ্বাসের কষ্ট আছে, তার পরও গলায় ঘর্ঘর শব্দ তুলে কথা বলতে বলতে তিনি লজেন্সের প্যাকেট খোলেন। খুদ-কুঁড়া দিলে যেমন ছানারা মুরগির ডানার কাছে চলে আসে, সে রকম আধন্যাংটা শিশুরা তাঁকে ঘিরে সিনডেবেলি ভাষায় কুটুরমুটুর করে। দুটি বাচ্চাকে তিনি বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে আমার কাছে টেনে এনে বলেন, ‘মিস্টার তো ডাক্তার, দেখো তো এদের কী হয়েছে?’ স্পষ্ট বুঝতে পারি, তাদের তীব্র জ্বর। সম্ভবত, মি. জবসন আমাকে ডক্টর সুলতান সম্বোধন করেন বলে তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন। না, আমি রোগী দেখার ডক্টর নই জানালে তিনি অবাক হয়ে বলেন, ‘তবে কি মিস্টার ভ্রাম্যমাণ ইন্ডিয়ান ব্যবসায়ী, সাদা চামড়ার সাহেবদের কাছে বিক্রি করেন স্মোকড স্যামোন, কনিয়াক, সিগার, ভায়েগ্রা ইত্যাদি?’ আমি একটু দ্বিধায় পড়ি। পেশা হিসেবে কনসালট্যান্ট বললে তিনি না আবার আমাকে কসাইফসাই কিছু মনে করেন।
ঠিক তখনই স্কুল থেকে ফিরে সালানিনি। মেয়েটির বোধ করি জন্ডিস হয়েছে। রোদের আঁচে ইয়োলো টোপাজ পাথরের মতো জ্বলজ্বল করে তার দুটি চোখ। তার শরীরে ক্যানসারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। জিম্বাবুয়ের বাজারে হালফিল ওষুধপত্র কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আমি তার জন্য বায়োপসি নিডল ইত্যাদি প্রিটোরিয়া থেকে নিয়ে এসেছি। ‘হ্যালো মিস, তোমার স্কুলে পড়ানো কেমন চলছে?’ সে ঠোঁট বাঁকিয়ে জবাব দেয়, ‘অল ক্র্যাপ, রিয়েল ক্র্যাপ। চার মাসের ওপর হয়ে গেল এক পয়সা মাইনে পাইনি।’ আমি এবার বায়োপসি নিডল ইত্যাদি বুঝিয়ে তাকে দিই। জিনিসগুলো হাতে নিতে নিতে যেন সম্ভাব্য বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে পারফিউমের শিশি নিচ্ছে—এ রকম ব্লাশ করে গণ্ডদেশ রক্তিম করে তুললে আমি তার অভিব্যক্তি নজর করে বিব্রত বোধ করি। একচিলতে জানালা দিয়ে হাওয়ায় গন্ধ আসে পচা ইঁদুরের, আর তার বাবা দূর দূর করে ওঠেন। সালানিনির সঙ্গে আমিও বেরিয়ে আসি বারান্দায়। মলিন চেহারার এক যুবক এসেছে, বোধ করি তার বয়ফ্রেন্ড হবে। তার বাবা হুইলচেয়ারে বসে তারস্বরে চেঁচান, ‘নামরদ কাহিকা, এক প্যাকেট সিগারেট, এক বোতল বিয়ার নিয়ে আসতে পারেনি, আবার এসেছে আমার মেয়ের হাত চাইতে।’ আমি পারিবারিক ডাইনামিক্সের অংশ হতে চাই না, সুতরাং গুডবাই বলি।
ডেভিড জবসন ভাজা গলদা চিংড়ির মতো লালচে হলুদ গাত্রবর্ণের এক সাহেবের সঙ্গে বিলিয়ার্ড খেলছিলেন। আমাকে দেখেই পর্টিকো থেকে নেমে এসে গাড়ি স্টার্ট দেন। ‘এ ম্যানশনের হোয়াইটরা তো দেখি বহাল তবিয়তে আছে, মুগাবের সাপরেসনে এদের কোনো সমস্যা হয়নি?’ ‘আরে মুগাবে তো কেবল হোয়াইট ফার্মারদের জমি কেড়ে নিয়েছে। ফার্মিংয়ে ফ্যামিলির ব্যবসা নয়। এরা এখন খুব ক্রিয়েটিভলি মানি ইনভেস্ট করছে। বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার কারণে জিম্বাবুয়েতে গাড়ি আমদানি নিষিদ্ধ। এরা বন্ধুবান্ধব জড়ো করে কেপটাউনে যায় ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির ডেলিভারি নিতে। তারপর কাগজে সাউথ আফ্রিকান দেখিয়ে ড্রাইভ করে তা নিয়ে আসে বুলাউয়েওতে। এখানে অর্থনৈতিক অবস্থা খুব কাহিল হলেও সরকারি জানুপিএফ পার্টির মিড-লেভেল ক্যাডারদের হাতে কীভাবে যেন পয়সা এসে যাচ্ছে। তারাই ব্ল্যাকে এ গাড়িগুলো কিনছে। সবাই মিলে যখন কেপটাউনে যায়, সালানিনির মা তাদের পিকনিক লাঞ্চ তৈরি করে দেয়।’
সালানিনির শরীরে খুব অ্যাগ্রেসিভ টাইপের ক্যানসার, চিকিৎসক বায়োপসিতে কনফার্ম করেছেন। এ জন্য প্রিটোরিয়া থেকে ওষুধ আনাতে হলে প্রয়োজন ফান্ডের। সাউথ আফ্রিকায় ‘ফ্রেন্ডস অব জিম্বাবুয়ে’ বলে একটি ফোরাম আছে। বায়োপসি নিডল ইত্যাদি তাদের অনুদানে কেনা হয়েছে। নতুন করে ফান্ডের জন্য তাদের মটিভেটেড করা দরকার। তাই ডেভিড সাহেব আমাকে অনুরোধ করেছেন তাঁর কাহিনি বর্ণনা করে একটি কেসস্টাডি লেখার জন্য। এ কারণে আমি তার সঙ্গে আরও দুবার সাক্ষাৎ করি। কুঁড়েঘরে গেলে কাচ্চাবাচ্চারা ‘মিস্টার, আমাদের জন্য বিস্কুট এনেছ কি’; তাদের বিকলাঙ্গ বাবা ‘পরেরবার আসার সময় কাইন্ডলি এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসো’—এসব বলে হাইচই বাধালে তার সঙ্গে ওখানে কথা বলা মুশকিল হয়। সুতরাং আমি তাকে নিয়ে বাইরে একটি ক্যাফেতে বসি। এতে কিছু কনফিউশনের সৃষ্টি হয়। তার মা আমাকে আবডালে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, ‘তাকে আউটিংয়ে নিয়ে যাও, অসুবিধা কিছু নেই। বাট ইউ আর অ্যা গুডম্যান, মিস্টার। তার এইডস আছে, তোমাকে সাবধান থাকতে হবে।’ যেহেতু তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কের কোনো অভিপ্রায় আমার ছিল না, সুতরাং তার সঙ্গে আলাপচারিতায় আমি কোনো ঝুঁকি দেখিনি।
কেসস্টাডিতে আমি যেসব তথ্য হাইলাইট করি, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: সিনডেবেলি ভাষায় ‘মাজাইরানার’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নৃত্যশিল্পী। সালানিনি খুব ভালো নাচে বলে তার নামের সঙ্গে এ লবজটি যুক্ত হয়ে গেছে। মাজাইরানার নামে বুলাউয়ে শহরের সর্বত্র সে মশহুর। সে মাতৃভাষায় কিছু কবিতা লিখেও যশস্বী হয়েছে। বছর দুয়েক আগে ডেভিড সাহেব তাকে পিয়ানো শেখার বন্দোবস্ত করে দেন। হুইলচেয়ারে বসা লোকটি তার পিতা নয়। তার আসল পিতা কে, এ বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই। তাদের মাঝেমধ্যে নির্জলা উপোস করতে হচ্ছে। সেক্স ওয়ার্কার সে নয়, তার পরও পরিবারের খাবার জোটানোর জন্য পর্যটকদের এনটারটেইন করতে হয়েছে বেশ কয়েকবার দৈহিকভাবে। তার বিকলাঙ্গ সৎপিতা চান, সে যেন ঘন ঘন ট্যুরিস্টদের সঙ্গ দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে সিগারেট ও লিকার নিয়ে। একটি বিষয়ে খটকা লাগে—তার অসুখের বিষয় আলাপ করলে সে মিটিমিটি হেসে গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে এমনভাবে তাকায়, যেন সম্ভাব্য বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে শুনছে নিরিবিলিতে ডেটে যাওয়ার প্রস্তাব।
ফ্রেন্ডস অব জিম্বাবুয়ের নিউজলেটার-এ কেসস্টাডি ছাপলে কিছু ফান্ডের সংস্থান হয়। টাকাটা ওরা পাঠায় ব্যাংক মারফত। আমি টাকা ওঠাতে গিয়ে দেখি, ব্যাংকের সামনে শতাধিক লোকের ভিড়। ব্যাংকে কোনো ক্যাশ না থাকার কারণে কাউকে টাকা উইথড্রো করতে দিচ্ছে না। ক্যাচাল চূড়ান্তে উঠলে ব্যাংকের প্রহরীদের সঙ্গে মিলেঝুলে পুলিশ ভিড়ে লাঠি চালায়। তাতে রীতিমতো মাথা ফাটাফাটি হলে আমি জীবন নিয়ে পালিয়ে এসে মি. ডেভিড জবসনকে টেলিফোন করি। তিনি জানান, গেল কয়েক দিন হলো জিম্বাবুয়ের কোনো ব্যাংকই কাউকে কিছু উইথড্রো করতে দিচ্ছে না। আমি যেন ফ্রেন্ডস অব জিম্বাবুয়ের লোকজনকে বলি, টাকা প্রিটোরিয়ায় ফিরে গেলে তারা যেন তা পাশের দেশ বতসোয়ানার ফ্রান্সিস টাউনে ডেভিড সাহেবের অ্যাকাউন্টে পাঠায়। একটু পর মি. ডেভিড আবার টেলিফোন করে বলেন, বিকেলে সালানিনি বুলাউয়ের আর্ট কাউন্সিলে পিয়ানো বাজাবে। তিনি গাড়ি পাঠাচ্ছেন। আমি যেন তাকে পিকআপ করি।
মসলিনের ফ্রিল দেওয়া শুভ্র গাউনের সঙ্গে ম্যাচ করা দস্তানা ও পালক গোঁজা হ্যাটে কোমর ঘুরিয়ে একপাক নেচে ‘সোসোলজা কুলেজো নাটাবা...সোসোলজা’ গাইতে গাইতে সালানিনি গাড়িতে এসে ওঠে। তার মা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘বি ভেরি টেন্ডার অ্যান্ড কাইন্ড টু হার। ডাক্তার কোনো ভরসা দিতে পারেনি, মিস্টার। হার ডেজ আর নাম্বারড।’
আর্ট কাউন্সিলের অনুষ্ঠানটি হয় ওয়ারেন হেস্টিংসের ছবির মতো, দেখতে কুঁকড়াচুলো ক্লোক পরা এক সাহেবের পাথরের ভিতে কাঠের দোতলা বাড়িতে। সাহেব সিঁড়িমুখে দাঁড়িয়ে বাও করে আমাদের ওপরে উঠতে ইশারা দেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নজরে পড়ে—জোড়ায় জোড়ায় বয়স্ক সাহেব-মেমরা ফিফটিজ মডেলের অস্টিন, হিলম্যান হান্টার প্রভৃতি গাড়িতে চড়ে এসে লনে নামছেন। হোস্ট সাহেব মেমদের হাত ধরে গাড়ি থেকে নামাচ্ছেন। দোতলার বিশাল হলঘরের এক পাশজুড়ে ডিসপ্লে করা হয়েছে ৬০-৭০ বছরের পুরোনো মডেলের কয়েকটি মারফি রেডিও ও গ্রামফোনের। এ পরিবেশে অত্যন্ত বিসদৃশ্য বদখত কিছু কাঁটাতার দিয়ে অ্যান্টিক বেতার ও কলের গানগুলো প্যাঁচানো। উর্দিপরা কৃষ্ণাঙ্গ খানসামা ট্রলিতে করে রেডওয়াইন সার্ভ করে। রবার্ট মুগাবের জানুপিএফ পার্টির সাপরেশন সত্ত্বেও শত শত বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গ যে জিম্বাবুয়ে ত্যাগ করতে অস্বীকার করেছেন—এ তথ্য এত দিনে আমি বেশ ভালো করে জেনে গেছি। তার পরও বিচিত্র এ অনুষ্ঠানে এসে তাদের নিজস্ব কৃষ্ণাঙ্গহীন পরিবেশে দাঁড়িয়ে বিষয়টি কেমন জানি হলিউডের সেটে সাজানো কলোনিয়্যাল যুগের দৃশ্যপটের মতো মনে হয়।
সালানিনি গ্রান্ড পিয়ানোর রিডে হাত দিলে পয়লা দখিনা বাতাসের মতো মৃদু ধ্বনি ছড়ায়। তারপর ঝংকৃত হয় চৈত্রের তীব্র তাপে কার্পাস ফেটে যাওয়ার মতো সরগরম আওয়াজ। ওয়াইনের গ্লাস হাতে ডেভিড সাহেব কাছে এসে বলেন, ‘ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, শি ইজ প্লেইং আলেকজান্ডার জারেপিনের সেকেন্ড সোনাটা।’ পিয়ানোতে এখন বাতাসে তুলা উড়ে যাওয়ার মতো মিহি সুর ঝুরছে। মি. ডেভিড আবার বলেন, ‘লুক, হাউ পাওয়ারফুলি, মেয়েটি ক্রোধের তীব্রতা প্রকাশ করে এখন তাতে বুনে দিচ্ছে হাতাশার ধূসর সুরজাল। ওয়েল, হাউ উড ইউ লাইক হার ড্রেস অ্যান্ড হ্যাট?’ ‘শি লুকস ইনোসেন্ট অ্যান্ড সুদিং ইন ইট’ বললে তিনি ভাস্কর যে রকম সম্ভাব্য ক্রেতাকে তার মূর্তি দেখায়, সেভাবে দেহভঙ্গি করে বলেন, ‘আমি তার জন্য এই ড্রেস ও হ্যাট লন্ডনের খুব দামি দোকান থেকে কিনে এনেছি।’
ফেরার পথে গাড়িতে বসে মনে হয়, শ্বেতাঙ্গদের এ অনুষ্ঠানে আমরা যেন রবাহূত ছিলাম। হোস্ট সাহেব তাবৎ মেমকে হাত ধরে খুব খাতির করে গাড়ি থেকে নামালেও তিনি সালানিনিকে আদনা হ্যালোও বলেননি। এখানে কেবল আমরা দুজনই ছিলাম অশ্বেতাঙ্গ। কৃষ্ণাঙ্গ খানসামাও কিন্তু আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়নি ওয়াই গ্লাস। আমি সালানিনির দিকে তাকাই। এ বর্ণবাদী আচরণে তার চোখেমুখে কিন্তু কোনো হেলদোল দেখি না। সে লক্কা পায়রার মতো খুব খোশমেজাজে গুনগুনিয়ে গাইছে, ‘সোসোলজা কুলেজো নাটাবা... সোসোলজা।’
ইঞ্জিনে কী ঝামেলা হচ্ছে, তাই গাড়ি পথের ধারে থামলে দেখি, ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে তাজা ফুল। ‘ইউ প্লেইড সো গুড। আসো, তোমাকে কিছু ফুল কিনে দিই, মিস’ বলে আমি গাড়ি থেকে নামতে গেলে সেও নামার উদ্যোগ নেয়। ফুলের দোকানের সামনে যেতেই সে পেছন থেকে বলে, ‘প্লিজ, ডোন্ট বাই ফ্লাওয়ার, মিস্টার।’ আমি ঘুরে তার দিকে তাকালে দেখি, সে তাকিয়ে আছে কসাইয়ের দোকানের দিকে। খুব আব্দার করে সে বলে, ‘উইল ইউ কাইন্ডলি বাই আস সাম মিট?’ না, পাউন্ড হিসাবে মাংস কিনতে সে রাজি হয় না। খুব লাজুকভাবে কেবল মাথাটি কিনে মৃদু স্বরে বলে, ‘সিনডেবেলি ভাষায় গোউটহেডকে বলে ইগলোগো। একটু মিলিপেপ মিলিয়ে এটা দিয়ে চমৎকার ডেলিকেসি রান্না করা যায়।’ বলে যেন মর্মে মরে যায়।
ম্যানশনের আঙিনায় গাড়ি থেকে নেমে আমাকে গুডবাই বলার জন্য ফিরে এসে জানালা দিয়ে সে বাড়িয়ে দেয় তার গণ্ডদেশ। তার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আমি চুমো খেলে অনুভব করি, তার সমস্ত শরীর পুড়ে যাচ্ছে তীব্র জ্বরে।
মাস সাতেক পর, আমি তখন হারারে শহরে কাজ করছি—ডেভিড জবসনের কাছ থেকে সংক্ষিপ্ত ই-মেইল পাই। গতকাল সালানিনির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হলো। যে সাদা গাউন আমি তাকে বিলাত থেকে আনিয়ে দিয়েছিলাম, তা পরেই সে কফিনবন্দী হয়ে গোরে গেল। ফ্রেন্ডস অব জিম্বাবুয়ের নিউজলেটার তাকে নিয়ে অবিচুয়ারি বা স্মৃতিতর্পণমূলক একটি লেখা ছাপতে চায়। আমি লিখলে বিষয়টি ইমোশনাল হয়ে যেতে পারে। তোমার সঙ্গে তো তার বেশ কয়েকবার দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ হয়েছে। তুমি কি কাইন্ডলি স্মৃতিচারণা করে একটি ছোট্ট লেখা পাঠাবে? সঙ্গে অ্যাটাচমেন্টে তিনি সালানিনির একটি ছবিও যুক্ত করে দিয়েছেন।
অবিচুয়ারি লিখতে বসে প্রথমে আমি তার ছবি ওপেন করি। কানসালট্যান্সির কাজে বেশির ভাগ সময় আমি হারারে বা অন্যত্র ব্যস্ত থাকার ফলে গেল সাত মাসে তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। তবে জানতাম, ফ্রেন্ডস অব জিম্বাবুয়ে বতসোয়ানার ফ্রান্সিস টাউনে ডেভিড জবসনের অ্যাকাউন্টের মারফতে কিছু টাকা পাঠিয়েছে। প্রিটোরিয়া থেকে বুলাউয়েগামী এক পর্যটকের মাধ্যমে তারা ওষুধপত্রও পাঠিয়েছে। যাক, এবার লিখতে হয়। আমি আবার তার ছবির দিকে তাকাই, মনে হয়, কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটি পদ্মপাতায় টলটলে জলের মতো বড় বড় দুটি চোখ মেলে তাকিয়ে আছে অদৃশ্য কোনো জগতের দিকে।
Mainussultan@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.