এখন বেতন বাড়ানো সম্ভব নয়: বিজিএমইএ-আশুলিয়ার সব কারখানা বন্ধ রাখার হুমকি

আগামী দুই দিনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আশুলিয়ার সব কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর ভাঙচুর ও সংঘর্ষের পর রাতে তৈরি পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পোশাকমালিকেরা এই মুহূর্তে পোশাকশ্রমিকদের বেতন বাড়ানো সম্ভব নয় বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবিও জানান মালিকেরা।
তৈরি পোশাক শিল্পকারখানার উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এতে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বিজিএমইএ কার্যালয়ের মিলনায়তনে সাড়ে তিনটায় সভা শুরু হয়। সভা শেষে রাত আটটায় বিজিএমইএর সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন পোশাকমালিকদের সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানান। এ সময় এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ, বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, শনি ও রোববারের মধ্যে যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, কারখানা ঠিকমতো না চলে ও উৎপাদন ব্যাহত হয়, তবে আশুলিয়ার সব কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় এটা করতে বাধ্য হবেন পোশাকমালিকেরা।
দেড় বছর আগে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে আর বেতন বাড়ানো সম্ভব নয় উল্লেখ করে মহিউদ্দিন বলেন, ‘গত এক বছরে পোশাক উৎপাদনের সব ধরনের ব্যয় বেড়েছে। অন্যদিকে আমেরিকা ও ইউরোপে রপ্তানি কমেছে যথাক্রমে ২৮ ও ১৫ শতাংশ। আমরা যখন নতুন বাজার খুঁজছি, তখন দেশি-বিদেশি একটি অপশক্তি পোশাক খাতকে অস্থির করে তুলছে।’
বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, ‘শ্রমিকেরা অভিযোগ করেছেন তাঁদের বাড়িভাড়া বছরে তিনবার বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আমরা সরকারের প্রতি আবেদন করেছি, যেন ভাড়া বছরে একবারের বেশি না বাড়ে।’
পোশাকশিল্পে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, যারা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিতে চান, তারা দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ জন্য কোনো প্রকার গুজবে কান না দিতে পোশাকশ্রমিকদের অনুরোধ করেন তিনি।
এর আগে মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ সব পোশাক কারখানার মালিকদের জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলাতে হা-মীম গ্রুপের কারখানার শ্রমিকদের আগামী নভেম্বরের ইনক্রিমেন্ট চলতি জুন মাসে এগিয়ে আনা হয়েছে। তিনি বাকিদের এটি দেওয়ার কথা বললে সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পোশাকমালিক এর বিরোধিতা করেন।
পরে সফিউল ইসলাম বলেন, ইনক্রিমেন্ট শুধু হা-মীম গ্রুপের কারখানার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর হবে না।
দিনভর সংঘর্ষ: সাভার থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলে গতকালও পোশাকশ্রমিকদের বেপরোয়া ভাঙচুর ও সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। ওই সময় শ্রমিকদের একাংশ তিনটি প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক লুটপাট চালায়। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক শ্রমিক ও বেশ কয়েকজন বাসযাত্রী আহত হন। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে টানা সাত ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। ছুটি ঘোষণা করা হয় তিন শতাধিক শিল্পকারখানায়।
যেভাবে সহিংসতা: স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ও স্থানীয় সাংসদ তৌহিদ জং মুরাদ গতকাল সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আশুলিয়ার নরসিংহপুরের হা-মীম গ্রুপে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রতিমন্ত্রী শ্রমিকদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ঘোষণা দিলে শ্রমিকদের একাংশ তা প্রত্যাখ্যান করে কারখানা থেকে বেরিয়ে যায়। এ সময় ওই এলাকার অন্যান্য কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক মূল ফটক ভেঙে হা-মীমের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। বাধা দিলে শ্রমিকেরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটার পাশাপাশি রাবারের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে পুলিশ। শুরু হয় শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এলাকা।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই সংঘর্ষের খবরে আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের উভয় পাশের সব কারখানাসহ আশপাশের এলাকার কারখানাগুলোয় ছুটি ঘোষণা করা হয়। শ্রমিকেরা বেরিয়ে এলে আবদুল্লাপুর-বাইপাইল সড়কের সাত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
ভাঙচুর, লুটপাট ও সংঘর্ষ: শ্রমিকেরা জিরাব, নরসিংহপুর, ইউনিক, জামগড়া ও বাইপাইল এলাকায় সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে এবং টায়ারে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। সকাল সাড়ে আটটার দিকে জামগড়া এলাকার ড্রেসআপ নামের একটি পোশাক কারখানার তিন শতাধিক শ্রমিক নিগার প্লাজার দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত পিজা হার্টস চায়নিজ রেস্টুরেন্টসহ যমুনা ব্যাংকের আশুলিয়া শাখায় ভাঙচুর ও লুটপাট চালান। পিজা হার্টসের ব্যবস্থাপক ফরিদ আহমেদ জানান, শ্রমিকেরা তাঁর প্রতিষ্ঠানে ঢুকে মালামাল ও আসবাব ভাঙচুর করেন। এরপর এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর নিচে নামিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন এবং ক্যাশ থেকে ৫৬ হাজার টাকা লুট করেন। এতে তাঁর প্রতিষ্ঠানের অন্তত ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কয়েক হাজার শ্রমিক লাঠি ও ইট হাতে একটি মিছিল নিয়ে বাইপাইলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে ইউনিক এলাকায় পুলিশ বাধা দেয়। শ্রমিকেরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে শুরু হয় সংঘর্ষ। একপর্যায়ে শ্রমিকদের তাড়া খেয়ে পুলিশ পিছু হটে একটি কারখানায় আশ্রয় নেয়। শ্রমিকেরা একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেন এবং যানবাহন ভাঙচুর করেন। পরে গরম পানি ছিটিয়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। সকাল ১০টার দিকে হাজার দুয়েক শ্রমিক মিছিল নিয়ে নবীনগর-কালিয়াকৈর সড়কে ওঠার চেষ্টা করলে পুলিশ রাবারের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। ওই সড়কের বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করেন শ্রমিকেরা।
বেলা ১১টার দিকে কয়েক হাজার শ্রমিক জামগড়ার আইডিএস গ্রুপে গিয়ে বাইরে থেকে ব্যাপক ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন এবং ফটক ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। বেলা একটার দিকে শ্রমিকেরা কারখানার পেছনের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে ভেতরে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালান। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা কারখানার ভেতরে আগুন ধরিয়ে দিলে অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে শ্রমিকদের ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
কারখানার ভান্ডাররক্ষক নিঝুম চন্দ্র দাস ও জ্যেষ্ঠ ক্রয় কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, সকাল আটটার দিকে তাঁদের কারখানায় ছুটি দিলে শ্রমিকেরা বাড়ি চলে যান। পরে অন্যান্য কারখানার শ্রমিক ও এলাকার লোকজন তাঁদের কারখানায় হামলা চালান।
প্রতিমন্ত্রীর আশ্বাস: স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক বেলা একটা পর্যন্ত হা-মীম গ্রুপে অবস্থান নিয়ে পোশাকশ্রমিক, নেতা ও কারখানার মালিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। এ সময় হা-মীম গ্রুপের মালিক ও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদও উপস্থিত ছিলেন। শ্রমিকদের দাবির মুখে প্রতিমন্ত্রী বলেন, হা-মীম গ্রুপের সব শ্রমিকের বেতন বাড়ানো হবে। জুন মাসের বেতনের সঙ্গে বাড়তি বেতন-ভাতা যোগ করে আগামী জুলাই মাসের ৭ তারিখের মধ্যে তা দেওয়া হবে।
একই সঙ্গে অন্যান্য কারখানার মালিকদেরও সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে জুন মাসের বেতনের সঙ্গে দেওয়ার অনুরোধ জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। বৈঠকে শ্রমিকেরা বলেন, আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলের বাড়ির মালিকেরা বছরে অন্তত তিনবার করে বাড়িভাড়া বাড়ান। যে পরিমাণ বেতন বাড়ে, তার চেয়ে তিন গুণ বাড়িভাড়া বাড়ে। এ কারণে বেতন বাড়লেও তাঁদের আর্থিক উন্নতি হয় না। এ জন্য তাঁরা শিল্প এলাকায় বাড়িভাড়ার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানান।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাড়ির মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সীমিত হারে বাড়িভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে স্থানীয় সাংসদসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। সাংসদ তালুকদার তৌহিদ জং ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
কাঁচপুরে বিক্ষোভ: সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুরে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপের প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক গতকাল সকালে কাজে যোগ না দিয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কারখানার ভেতরে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এ সময় শ্রমিকেরা ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ ব্যাপারে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা গ্রুপের পরিচালক (প্রশাসন) দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশুলিয়ার শ্রমিক অসন্তোষের জের ধরেই শ্রমিকেরা সকালে কাজে যোগ না দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। আমরা তাঁদের দাবিদাওয়া সঞ্চারকলিপির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলি। কিন্তু শ্রমিকেরা আমাদের কথা না মেনে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে থাকেন। বাধ্য হয়ে দুপুরের পর কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়।’

No comments

Powered by Blogger.