পাকিস্তান-সংখ্যালঘুদের জন্য আমরা কী করতে পারি by হামিদ মির

ভারতে বাবরি মসজিদ মামলার রায়ের প্রতিবাদে অনেক পাকিস্তানি কেন পথে নেমে এসেছে? এলাহাবাদ হাইকোর্টে এ মামলার রায় ঘোষণা করার পর পাকিস্তানের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে করাচি ও লাহোরে কিছু বিক্ষোভ মিছিল দেখার পর থেকেই এ প্রশ্নটা আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।


সন্দেহ নেই, অনেক পাকিস্তানিই এ রায়কে ‘আইনগত’ নয়, বরং ‘রাজনৈতিক’ মনে করে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে টিভি চ্যানেলে এ দৃশ্য দেখে আমি বেশ বিরক্ত হয়েছি। যেখানে আমারই এক বন্ধু দাবি করেছেন, ‘পাকিস্তানে কখনো কোনো হিন্দু মন্দির আক্রমণের শিকার হয়নি। কিন্তু হিন্দুরা ভারতে অনেক মসজিদ ধ্বংস করেছে।’
আমার মনে পড়ে, ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর পাকিস্তানে বেশ কয়েক ডজন হিন্দু মন্দির আক্রমণের শিকার হয়েছে।
যদি বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাটা অন্যায় হয়ে থাকে, তবে পাকিস্তানে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করাটাও অন্যায় ছিল। এলাহাবাদ হাইকোর্টের এ রায়ের আড়ালে অবশ্যই আমাদের খারাপ কাজগুলো লুকানো উচিত নয়।
সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ; পাকিস্তানে বেশ কিছু স্পষ্টবাদী ও সাহসী বিশ্লেষক আছেন। যাঁরা বলেছেন, বাবরি মসজিদ নিয়ে আমাদের রাজনীতি করা উচিত নয়। মুম্বাই আক্রমণের পর ভারতের টিভি চ্যানেলগুলো যে আচরণ করেছে, পাকিস্তানের অধিকাংশ টিভি চ্যানেল কখনোই তা করেনি।
এই প্রথম পাকিস্তানের গণমাধ্যম হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টা করেনি। পাকিস্তানের বৃহৎ বেসরকারি সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেল জিয়ো টিভির ভূমিকা ছিল বেশ ভারসাম্যপূর্ণ। এটি গুরুত্ব দিয়েছে এলাহাবাদ হাইকোর্ট বেঞ্চের তিন বিচারপতির মতামতের ওপর, যার মধ্যে এস ইউ খান নামের একজন মুসলিম বিচারকও ছিলেন। তিনিও অযোধ্যার ওই জমির তিন ভাগ করাটা সমর্থন করেছেন।
পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলমান সুন্নি ধারায় বিশ্বাসী। এ ধারার চিন্তাবিদ মুফতি মুনেবুর রহমান গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে জিয়ো টিভির প্রধান সংবাদ বুলেটিনে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় রাজনৈতিক। একই সঙ্গে তিনি ভারতের মুসলিমদের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ইসলামের নামে সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে।
মুফতি মুনেবুর রহমানের উচিত ছিল পাকিস্তানি মুসলমানদের বলা, বাবরি মসজিদের নামে যারা সহিংসতা ছড়াতে চায়, তাদের সঙ্গে হাত মেলাবেন না।
আমার মনে পড়ে, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় পাকিস্তানে বহু হিন্দু মন্দির আক্রমণের শিকার হয়েছিল। একজন তরুণ প্রতিবেদক হিসেবে আমি লাহোরে এ রকম অনেক ঘটনা কভার করেছিলাম।
ভারতের হিন্দুরা ভারতের মুসলমানদের শত্রু, এমন একটি মনোভাব তৈরি করার জন্য তখন উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো এ পরিস্থিতিকে পুরোপুরি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছে। যদিও ব্যাপারটা তেমন ছিল না।
২০০১ সাল পর্যন্ত বিতর্কিত বাবরি মসজিদ ইস্যুটি পাকিস্তানের অনেক ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী ও লেখকদের রাজনীতি করার পছন্দের বিষয় ছিল। কিন্তু ৯/১১-এর ঘটনা পুরো প্রেক্ষাপটই বদলে দিয়েছে এবং পাকিস্তানের উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্য ভারত থেকে পরিবর্তিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে চলে গেছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২০০৭ সালে ইসলামাবাদের লাল মসজিদে আক্রমণ করার পর দেশটিতে বাবরি মসজিদ বিতর্ক গুরুত্ব হারায়।
পাকিস্তানি মুসলমানদের একটা বড় অংশ মনে করে, প্রধান বিচারপতি বিতর্ক নিয়ে দেশটির আইনজীবীদের আন্দোলন থেকে সাধারণ জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারভেজ মোশাররফ নিজে লাল মসজিদ অভিযান নাটক তৈরি করেছিলেন।
আমার মনে পড়ে, ২০০৭ সালে অনেক মুসলিম বুদ্ধিজীবী বলেছিলেন, যেসব উগ্রবাদী হিন্দু বাবরি মসজিদ আক্রমণ করেছে, তাঁরা সব সময় তাদের নিন্দা জানাবেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ইসলামাবাদের একটি মসজিদে হামলা চালাল, এখন তাঁরা কী বলবেন?
লাল মসজিদ অভিযান পাকিস্তানে জঙ্গিবাদ উসকে দিয়েছে এবং যা ছিল ইতিহাসের নতুন মোড়। এর পর থেকেই জঙ্গিরা সারা দেশে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী হামলা পরিচালনা করে। এমনকি তাঁরা যেসব মসজিদে নামাজ আদায় করতেন, ওসব মসজিদও জঙ্গিদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
সোয়াত, বুনার, দির, খাইবারসহ পাকিস্তানের অনেক এলাকায় মসজিদ ধ্বংসের ওই দৃশ্য কীভাবে আমি ভুলে যাই। ওগুলো মুসলমানদের দ্বারাই ধ্বংস হয়েছে, হিন্দুদের দ্বারা নয়।
অধিকাংশ মসজিদই আত্মঘাতী হামলাকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল এবং কিছুসংখ্যক মসজিদ জঙ্গি ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়। রাওয়ালপিন্ডির প্যারাডে লেন মসজিদের ওপর হামলার দৃশ্য আমি কীভাবে ভুলি। মসজিদটি শ্মশ্রুধারী জঙ্গি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল এবং তালেবান এ হামলার দায়িত্বও স্বীকার করেছিল।
এটা স্বীকৃত যে হিন্দু উগ্রবাদীদের দ্বারা ভারতে যতগুলো মসজিদ ধ্বংস হয়েছে, মুসলিম জঙ্গিরা পাকিস্তানে তার চেয়ে বেশি মসজিদ ধ্বংস করেছে।
ভারতে হিন্দু ও মুসলিমদের বিবাদ আইনি প্রক্রিয়ায় মিটিয়ে ফেলতে দেওয়া উচিত। বাবরি মসজিদ নিয়ে আমাদের রাজনীতি করা উচিত নয়। পাকিস্তানি হিসেবে অবশ্যই আমাদের সংখ্যালঘুদের আইনগত, রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে সুরক্ষা প্রদান করা উচিত।
আমি ইতিমধ্যে সরকার ও বিরোধী দলের অনেক বন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছি, পাকিস্তানি হিন্দু, শিখ ও খ্রিষ্টানদের প্রতি আমাদের আরও যত্নশীল হওয়া উচিত। তারা যতটা চায় ততটা মন্দির ও গির্জা নির্মাণ করার অনুমতি দেওয়া উচিত। আমাদের কর্তব্য, পাকিস্তানের যেসব শক্তিশালী ভূমিদস্যু, যারা সব সময় সিন্ধু ও মধ্য পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দু মন্দির ও গির্জার জমি গ্রাস করার চেষ্টা করে, তাদের নিরুৎসাহিত করা। উগ্রবাদীদের কোনো ধর্ম নেই। তারা কখনো ইসলামধর্মের নামে, কখনো হিন্দুধর্মের নামে এবং কখনো খ্রিষ্টধর্মের নামে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। আমাদের উচিত এদের নিন্দা জানানো।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে জহির উদ্দিন বাবর ভারতজুড়ে শুধু মসজিদই নির্মাণ করেননি, তিনি অনেক হিন্দু মন্দিরও নির্মাণ করেছেন। আমরা তাঁর নামে একটি হিন্দু মন্দির নির্মাণ করতে পারি। সমগ্র সীমান্তে এটা একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে।
যখন একটি ভারতীয় আদালত ২০১০ সালে বাবরি মসজিদের জমি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়, তখন পাকিস্তানিদের উচিত প্রতিশোধ না নিয়ে বরং একটি হিন্দু মন্দির নির্মাণ করা। এটা দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ হবে না, এটা হবে শুভ ইচ্ছার নিদর্শন। এর ফলে ভারতীরা বিশ্বাস করবে, পাকিস্তান বদল হচ্ছে এবং তাদেরও উচিত চিন্তার ধরন পরিবর্তন করা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
হামিদ মির: নির্বাহী সম্পাদক, জিয়ো টিভি, পাকিস্তান।

No comments

Powered by Blogger.