ধর্ম-ইসলামে প্রবীণের অধিকার by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

আবহমানকাল ধরে ইসলামে প্রবীণদের প্রতি দায়দায়িত্ব পালন এবং তাঁদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকার রেওয়াজ চালু রয়েছে। মুসলিম সমাজে বয়সে কিছুটা বড় হলে তাঁকে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হয়, শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার প্রদর্শনে বয়োকনিষ্ঠরা তৎপর থাকে।


প্রবীণ বা পিতা-মাতার সমতুল্য ব্যক্তিদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে সাধারণত কেউ কার্পণ্য করে না। সমাজে মুরব্বি মানুষ দেখলে দাঁড়ানো কিংবা সালাম দেওয়ার প্রচলন ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু সমাজে প্রচলিত রুচি-প্রথা অনেক ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে যেতে বসেছে। পিতা-মাতা সারা জীবন তাঁদের সন্তানকে আগলে রেখে বড় করে তোলেন, তাঁদের বৃদ্ধাবস্থায় পূর্ণ সেবা করা সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব। অথচ এ কর্তব্য থেকে মানবসন্তান বহু দূরে সরে যাচ্ছে। বৃদ্ধ পিতা-মাতা অনেক ক্ষেত্রে নিজ ঘরেই পরবাসী, অথবা ছেলের বিয়ের পর বাবা-মায়ের প্রতি যথাযথ যত্ন নেওয়া হয় না, অবহেলার একপর্যায়ে সদ্ব্যবহার তিরোহিত হয়। বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে উপযুক্ত মর্যাদা না দেওয়ার পীড়াদায়ক অভিযোগও শোনা যায়। অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। আমার প্রতি ও আমার পিতা-মাতার প্রতি তুমি যে অনুগ্রহ করেছ, তার জন্য এবং যাতে আমি সৎকাজ করতে পারি, যা তুমি পছন্দ করো।’ (সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ১৫)
ইসলামে প্রবীণদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা মুসলমানদের ঐতিহ্য। প্রবীণ ব্যক্তি সমাজে দর্পণস্বরূপ। তাঁদের প্রতি সম্মানসূচক ব্যবহার সমাজকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখে। কিন্তু আধুনিককালে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে মর্যাদা না দেওয়ার ফলে পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে ও পরিবার প্রথা হুমকির মুখে পড়ছে। মানবজীবনের প্রতিটি পর্যায় যেমন শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য—এগুলোরই পৃথক পৃথক সৌন্দর্য আছে। বার্ধক্যের সৌন্দর্য অভিজ্ঞতার এক বিশাল ভান্ডার। বার্ধক্যেই জীবনকে সবচেয়ে পরিপূর্ণভাবে দেখা যায়। প্রবীণ ব্যক্তি নিজেদের সংসারে সব দায়িত্বের ভার বহনকারী। প্রবীণদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই সমাজ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। প্রবীণেরা যেমন বয়োবৃদ্ধ তেমনি জ্ঞানবৃদ্ধও। তাঁদের অভিজ্ঞতা বয়োকনিষ্ঠদের জন্য আলোকবর্তিকা এবং জীবনকে সক্রিয় রাখার প্রেরণাস্বরূপ। প্রবীণদের প্রাপ্ত শিক্ষা জীবনের জয়গান গাওয়ার মতো যথেষ্ট মাত্রায় সহযোগী। অমানিশার অন্ধকার কাটিয়ে তুলতে যে নৈতিক শিক্ষার আলোকচ্ছটার প্রয়োজন, তা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে দিশারূপে কিছুটা হূদয়ঙ্গম করা সম্ভব। একজন প্রবীণ অভিজ্ঞতাবলে দূরদৃষ্টি ক্ষমতার প্রয়োগ দেখাতে পারবেন। ভালো কাজে যেমন নবীন-প্রবীণের একাত্মতা প্রয়োজন, তেমনি প্রবীণের প্রতি নবীনের পুরোপুরি শ্রদ্ধাবোধ থাকা বাঞ্ছনীয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যে নবীন বয়স্কদের সম্মান করে, আল্লাহ তাআলা যেন তার বার্ধক্যকাল এলে তার জন্য তেমনি সম্মানকারী নিয়োগ করেন।’
মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটে, চিন্তার জগতে শৃঙ্খলা আসে, অগোছালো ভাবনাগুলো স্থিরিকৃত হয়। সাধারণত বয়স বাড়লেই চিন্তামূলক বড় কিছু অর্জনের যোগ্যতা তৈরি হয়। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন। যে তরুণ চিত্ত অসহিষ্ণু, অধৈর্য ও অস্থির মানসিকতায় সদা আলোড়িত, সেই মনই একসময় বয়সের ভারে স্থির, নীরব হয়ে পড়ে। কিন্তু বয়সের ভারে কুঁজো ন্যুব্জ হলেই শক্তি বিলুপ্ত হয়, সব জড়তা, দুর্বলতা এসে শরীর ও মনে ভর করে। তারুণ্যে যিনি শক্তির মূর্ত প্রতীক হয়েছিলেন, বার্ধক্য তাঁকে কাবু করতে কসুর করে না।
প্রবীণ ও নবীনের পারস্পরিক কাজকর্মের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা গড়ে ওঠে। প্রবীণের অভিজ্ঞতার ঝুড়ি নবীনের জন্য অনেক বড় জ্ঞানের ভান্ডার। প্রবীণ মানে জ্ঞানের মশাল, ধীর, স্থির এবং শান্ত-সৌম্যের রূপকার। প্রবীণ হলেন সামাজিক শিক্ষার কথামালা, বহুবিধ অর্জনের সাক্ষাৎ নায়ক। এ ধরনের প্রবীণেরা তরুণদের মনে জাগরণী সুরের ঝংকার তোলেন। তাঁরা হলেন শিক্ষাগুরু, পথের দিশা, অন্ধকারের আলোকবর্তিকা। নবীনেরা প্রবীণদের কাছ থেকে উত্তম ও গঠনমূলক কাজের দীক্ষা লাভ করে। রোদের তেজ এবং বারিধারা থেকে রক্ষা পেতে পথিকের মাথার ওপর যেমন ছাতা থাকা অপরিহার্য, তেমনি নবীনের জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হওয়া কিংবা হূদয়-মনকে প্রসারিত বা জ্ঞানালোকে আবাহন করার জন্য প্রয়োজন ধর্মপ্রাণ প্রবীণের সান্নিধ্য, সাহচর্য ও হিতোপদেশ তথা দিকনির্দেশিকা। তাই প্রবীণদের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে সফল ও সমৃদ্ধ করা দরকার।
আজ যে শিশু, কাল সে-ই শিশুর পিতা। সময়ের বিবর্তনে শিশু-যুবক, আবার যুবক-বৃদ্ধে পরিণত হয়। একদিন যে মানুষ বহু আশা ও স্বপ্ন নিয়ে তৈরি করে সংসার, সেখানে মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে নিয়ে তৈরি হয় ভালোবাসার পরিবার, একসময় সেই প্রিয় লোকটি হয়ে পড়েন সংসারে অপ্রয়োজনীয়। পরিবারের বা জীবনের প্রায় কোনো কাজেই আর লাগে না। সংসারের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ থেকেও তখন তিনি বহু দূরে। সংসারের মধ্যে থেকেও তিনি সংসারের বাইরে। এই যে সুদূর, বিচ্ছিন্ন জীবন, এরই নাম বার্ধক্য; যা মানবজীবনের সর্বশেষ অধ্যায়। নির্দিষ্ট সময় বেঁচে থাকলে বার্ধক্য আসবেই। এ সময় জীবনযাপনের সমস্যাই হলো প্রবীণদের প্রধান সমস্যা। বার্ধক্যের কারণে তাঁরা যেন অসহায় হয়ে পড়েন। উপযুক্ত খাদ্য, পরিচর্যা, স্বাস্থ্যসেবা, বাসগৃহ প্রায় সব মানবাধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত ও উপেক্ষিত হন। অনেকে বার্ধক্যের কারণে নিজ সংসারে পরবাসী জীবনযাপন করেন। অনেক সন্তান নিজের বাবা-মাকে বার্ধক্যে সংসারের ঝামেলা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসে। যদিও প্রবীণেরা বৃদ্ধাশ্রমে খাওয়া-পরা সবকিছুই সঠিকভাবে পেয়ে থাকেন, কিন্তু নিজেদের আপনজন ছেড়ে একাকিত্ব জীবন যে কত কষ্ট ও বিষাদের তা বলাইবাহুল্য। অথচ ইসলামের বিধানে প্রবীণেরা আমাদের ভালোবাসা, যত্ন ও শ্রদ্ধা পাওয়ার অধিকারী।
পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবীণদের অবদান অপরিসীম। প্রবীণেরা তাঁদের সমগ্র কর্মময় জীবন পরিবারের গঠন, উন্নয়ন ও সমাজের কল্যাণে ব্যয় করে একসময়ে এসে এই বার্ধক্যে উপনীত হন। তখন প্রবীণদের সার্বিক কল্যাণ ও সুরক্ষা করা সমাজের কর্তব্য হলেও তাঁদের সুযোগ-সুবিধার কোনো বালাই নেই। বার্ধক্য বর্তমান বিশ্বের একটি অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। মুরব্বিদের প্রতি দায়িত্ববোধে উজ্জীবিত করা সম্পর্কিত একটি হাদিসে বর্ণিত আছে যে একদা একজন সাহাবি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! (সা.) আমি আমার বৃদ্ধ-অচল মাকে কাঁধে নিয়ে উত্তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়েছি।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) জবাবে বললেন, ‘তোমার মা তোমার জন্মের সময় যে কষ্ট ভোগ করেছেন, সে তুলনায় তুমি খুব কমই করেছ।’ এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে মুরব্বিদের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমাদের সার্বক্ষণিকভাবে তৎপর থাকা অবশ্যকর্তব্য।
প্রবীণেরা আমাদের সমাজেরই মানুষ। তাঁদের অশেষ অবদানে সমাজ-সংসারের সৃষ্টি, তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সমাজে সবাই প্রতিষ্ঠিত। তাই সমাজের শীর্ষস্থান তাঁদেরই প্রাপ্য। তাঁদের যথার্থ মূল্যায়ন করা হলে আগামী প্রজন্মও আমাদের মূল্যায়ন করবে। তাই কোনো প্রবীণ অবহেলা-নির্যাতনের শিকার যেন না হন। কোনো সন্তান যেন তার বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে ঝামেলা না মনে করে। জনমনে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রবীণ সমস্যার সমাধান করতে হবে। সমাজ ও সংসার তখনই সুন্দর ও সুখময় হয়ে উঠবে, যখন প্রবীণেরা নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারবেন। তাই সমাজের যেকোনো স্তরে, যেকোনো কালে আমাদের প্রয়োজন নবীন-প্রবীণনির্বিশেষে এমন ব্যক্তি, যিনি হবেন বিশুদ্ধ, প্রবীণের প্রতি দায়িত্বসচেতন, নবীনের জন্য ভালো কাজের উৎসাহদাতা। সমাজের হাল ধরার জন্য প্রজ্ঞাবান, শ্রদ্ধাভাজন আল্লাহভীরু প্রবীণ ব্যক্তিদের যথাযথ আসনে সমাসীন করা শুধু সমাজের দাবি নয়, ইসলামধর্মেরও নির্দেশ। তাই মানুষে মানুষে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, গুরুজনদের প্রতি সম্মান ও দায়দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে যাতে সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত করা যায়, সেদিকে আমাদের অত্যন্ত সজাগ-সচেতন দৃষ্টি রাখা জরুরি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।

No comments

Powered by Blogger.