ঢাকার পরিবেশ ও যানজট by ড. মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান

পরিকল্পিত নগরায়ণ আজকের সময়ের দাবি। অনেকেই বলে থাকেন, ক্রমবর্ধিষ্ণু ঢাকা আজ বসবাসের অনুপযোগী। বলা প্রয়োজন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ঢাকায় বিদ্যমান থাকলেও দুর্ভাগ্যবশত আমরা তা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। অপরিকল্পিতভাবে বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন গড়ে ওঠার ফলে ঢাকা আজ স্থবির।


আমাদের মুভমেন্ট কচ্ছপ গতির। মানুষ যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় যানজটে আটকে থাকে তখন ঢাকা শহরের ওপর মানুষের যে খেদোক্তি শোনা যায় বর্তমান ঢাকার সেটাই প্রকৃত বিবরণ। অল্প বৃষ্টিতে জলমগ্ন হওয়া, যেখানে-সেখানে নাগরিক সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে জনগণের ভোগান্তি প্রায় নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাস যখন আমরা পড়ি, তখন বলে উঠি_কোথায় হারিয়ে গেল ঢাকার খাল, কোথায় বিল-ঝিল। টেমস নদীর সঙ্গে যে বুড়িগঙ্গাকে তুলনা করা হতো, সেই বুড়িগঙ্গা আজ মৃতপ্রায়। শীর্ণকায় বুড়িগঙ্গা আজ কালের সাক্ষী হয়ে আছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্যে দূষিত বুড়িগঙ্গার পানিতে আজ মাছ বেঁচে থাকার মতো অবস্থাও নেই। আমরা জানি, ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহের একটা বড় উৎস হলো বুড়িগঙ্গা। এই বুড়িগঙ্গার পানি এতই দূষিত যে এই পানি শোধন করার পরও মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে আমরা ওয়াসার দূষিত পানি সরবরাহের খবর দেখতে পাই। ঢাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ দুই দশক ধরে নষ্ট হতে হতে একেবারে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে। তবে এর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ঢাকার যানজট। যানজট নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং তা নিরসনের কিছু উপায় বলতে চাই। যানজট এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়_সেটা সরকার বা জনগণ সবার জন্যই। মানুষ স্বভাবগতভাবেই গতিপ্রিয়। বাংলাদেশ সরকারের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত কোন খাতে? এ প্রশ্নে বেশির ভাগ মানুষের উত্তর হলো যানজট, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও যানজট নিরসনে। এ অভিমত শুধু আমার নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। সবাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চায় এবং যথাসময়ে গন্তব্যে পেঁৗছতে চায়। মানুষের কর্মঘণ্টার পারিশ্রমিক যদি হিসাব করা হয় দেখা যাবে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে রাস্তায়। তাই যানজট নিরসন আজ অন্যতম দাবি। যানজট নিরসনে প্রথমে এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। যানজটের কারণগুলো চিহ্নিত হওয়ার পর তা নিরসন সহজ হবে। আমি বলতে পারি, মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি এবং বিলাসী জীবনযাপন যানজট সৃষ্টিতে অনেকটা দায়ী। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের যথাযথ পদক্ষেপেরও অভাব রয়েছে। প্রাইভেট গাড়িতে সাশ্রয়ী সিএনজি ব্যবহারের সুবিধা, প্রাইভেট গাড়ির মূল্য কমে যাওয়া কিংবা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসায় সম্প্রতি প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। আমরা জানি, উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে প্রায় জনপ্রতি প্রাইভেট গাড়ি রয়েছে। তার পরও সেখানে যানজট নেই। কারণ সেখানে পরিকল্পিত এবং যান চলাচলের যথেষ্ট রাস্তা রয়েছে। আমাদের ঢাকা সেভাবে গড়ে না ওঠায় রাস্তার অভাব রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোয় প্রাইভেট গাড়িতে সিএনজি প্রদানে বিধিনিষেধ রয়েছে। সরকারি ও যাত্রীবাহী পরিবহনেই শুধু সিএনজি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও এই বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন সময়ের দাবি। ঢাকায় যেখানে-সেখানে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক ছাত্র পরিবহন বাস চালু করা যেতে পারে। কোনো অভিভাবক ইচ্ছা করলেই তার সন্তান বা পোষ্যকে ব্যক্তিগত গাড়িতে স্কুলে আনা-নেওয়া করতে পারবেন না। আমার জানামতে, ঢাকায় বসবাসকারী যাদের প্রাইভেট গাড়ি রয়েছে তাদের গাড়িপ্রতি বছরে ২০ হাজার টাকা করে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা অফিসে প্রদান করতে হয়। এর মধ্যে রুট পারমিট, গাড়ি ও নিজের লাইসেন্স নবায়ন, গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা ইত্যাদি রয়েছে। আমি মনে করি, সরকার এ ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করে একত্রে বছরের শুরুতে আগাম হিসেবে আদায় করতে পারে। এই টাকা দিয়ে ঢাকা শহরজুড়ে দ্বিতল রাস্তার কাজ শুরু করা হবে। আবার দ্বিতল রাস্তা ব্যবহার বাবদ গাড়িপ্রতি টোল দিতে হবে। এসব টাকা ব্যয় হবে রাস্তা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ খাতে। ঢাকার যানজট নিরসনে প্রাইভেট গাড়িগুলোর ব্যাপারে সরকার আরো কিছু নিয়মনীতির প্রচলন করতে পারে, যার মাধ্যমে প্রাইভেট গাড়ির প্রতি মানুষের আগ্রহ কমবে।
ঢাকা পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ শহরের একটি। ঢাকার লোকসংখ্যা এখন দুই কোটির কাছাকাছি। অন্তত ৫০ লাখ মানুষকে ঢাকা থেকে বাইরে পাঠানো যেতে পারে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। নিম্ন আদালত আবার উপজেলায় পাঠানো যেতে পারে। ঢাকার গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢাকার বাইরে পাঠানো গেলে ঢাকার জনসংখ্যা তিন-চতুর্থাংশ কমে যাবে। এ জন্য ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোয় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। মেগাসিটি হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলতে হলে এবং যানজট নিরসনকল্পে ফুটপাত হকারমুক্ত করতে হবে। হকারদের নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় ব্যবসা করার সুযোগ দিতে হবে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ ক্ষেত্রে যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তা পুনর্মূল্যায়ন করে সপ্তাহে দুই-তিন দিনের পরিবর্তে সাত দিনই ব্যবসা করার সুযোগ করে দিতে হবে। ফুটপাত দখলমুক্ত করা গেলে অল্প দূরবর্তী গন্তব্যে লোকজন স্বেচ্ছায় হেঁটে চলাচল করবে। আজকাল ইচ্ছা করলেও ঢাকায় হাঁটার জায়গা নেই।
এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা সীমিতকরণ করতে হবে। লোকজনকে বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেল চালানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। উলি্লখিত প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে টেকসই সফলতা আসতে পারে।
- লেখক : উপ-উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.