চারদিক-টুঙ্গিপাড়ায় এক দিন by শারমিন নাহার

ঈদের ছুটিতে গোপালগঞ্জে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, শুধু শুধু বসে না থেকে কোথাও বেড়িয়ে আসি। জায়গা নির্বাচনে কালক্ষেপণ না করে ঐতিহাসিক টুঙ্গিপাড়াকেই বেছে নিলাম। আমার সঙ্গীরাও বেশ আগ্রহ দেখাল। সুতরাং খুব একটা সমস্যা হলো না। গোপালগঞ্জ জেলা শহর থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট সুনিবিড় টুঙ্গিপাড়া থানা।


তার এক পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মধুমতী নদী। যদিও সময়ের স্রোতে এই নদী হারিয়েছে তার যৌবন।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঈদের পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়ি। সকাল নয়টা বাজতেই ঘরের দরজায় টমটম এসে হাজির। টমটম নাম শুনেই মনে হতে পারে, এটা হয়তো ঘোড়ার গাড়ি। কিন্তু না, ব্যাটারিচালিত একধরনের অটোরিকশা। স্থানীয়দের কাছে টমটম নামেই পরিচিত। আমরা পাঁচজন চেপে বসি টমটমে। আমাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ফিদেল অনন্য। ফিদেলের বয়স দুই ছুঁইছুঁই। টুঙ্গিপাড়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ফিদেলের বোঝার কথা না। সে জানেও না আমরা কোথায় যাচ্ছি। তবে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে। টমটমে চেপে বসতেই ফিদেলের উৎফুল্লতা আরও বেড়ে গেল।
রাস্তার দুই পাশে সারি সারি অড়হড়গাছগুলো পেছনে ফেলে ছুটে যাচ্ছি আমরা। শরতের আকাশটা একেবারে স্বচ্ছ। স্বচ্ছ আকাশে তুলোর মতো মেঘ যেন আপন মনেই খেলা করে চলেছে। আরও কিছু দূর যেতেই কাশবন। রাস্তার দুই ধারে মনোরম দৃশ্য উপভোগের রেশ কাটতে না-কাটতেই রাস্তা শেষ হয়ে এল। আধা ঘণ্টা বাদেই পৌঁছে গেলাম টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে। টমটম থামতেই সবার আগে নেমে পড়ল ফিদেল। ওর উৎসাহ আমাদের অবাক করল। এই বাড়িটা ঘুরে দেখতে একবারও ক্লান্ত হলাম না আমরা, খুব বেশি সময়ও লাগল না। একে একে আমরা পুরোনো ভবনের জাদুঘর, পাঠাগার আর মাজার ঘুরে দেখলাম। পাঠাগারে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের বিপুল সমাহার। স্থানীয় লোকেরা দুই থেকে সাত দিনের জন্য একটা বই ধার নিতে পারেন। আর দর্শকেরা পড়তে চাইলে পাঠাগারে বসেই পড়তে পারেন। পুরোনো ভবনের জাদুঘরে রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নানা ছবি, পুরোনো কিছু আসবাব। যার সবই এখন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।
এখানে এসে কথা হলো বৈকুণ্ঠনাথ বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি এই বাড়িতে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে আছেন। স্থানীয়দের কাছে তিনি প্রিয় বৈকুণ্ঠ দা। কথা হয় বৈকুণ্ঠ দার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই এই বাড়িতে আছি। এই বাড়ির ওপরে একটা মায়া পড়ে গেছে।’ কাছেই তাঁর নিজের বাড়ি, তার পরও এখানেই থাকেন তিনি। বাড়িটাকে আগলে রাখেন নিজের করে। বাড়ির পুরোনো গাছগুলোও যেন ইতিহাসের সাক্ষী। পুরোনো গাছগুলোকে না কেটে গুঁড়ি বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশের জেলা পিরোজপুর থেকে সপরিবারে বেড়াতে এসেছেন রাকিব হোসেন। তিনি বলেন, ‘আগেও আমি এখানে এসেছি। কিন্তু আমার সন্তানেরা আসেনি, তাই তাদের এবার নিয়ে এলাম। কেননা প্রকৃত ইতিহাস তো জানাতে হবে।’
এদিকে ঢাকা থেকে আসা ছোট্ট প্রিয়াংকা তার ঈদের ‘ওয়াকা ওয়াকা’ জামাটা পরে এসেছে বেড়াতে। প্রিয়াংকা বাবার কাছ থেকে গল্প শুনেই জেনেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। এ জায়গায় আসতে পেরে ভালো লাগছে তার। বন্ধুদের কাছে এবার সে গল্প করবে। সবকিছু ঘুরে দেখতে দেখতে মনের মধ্যে নানা ধরনের চিন্তা উঁকিঝুঁকি শুরু করে।
সময় গড়াতে থাকে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। আমরা টমটমে ওঠার জন্য এগোতে থাকি। কিন্তু পেছন ফিরে দেখি ফিদেল নেই। সে টমটমে না উঠে পেছন দিকে ছুটল। ফিদেল যাবে না। এখানে থাকবে। হয়তো বা সে বুঝেই থেকে যেতে চাইছে। ফিদেল এখানেই থাকুক না। অন্তত মনে মনে। বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে হলে তো এখানে এসে দাঁড়াতে হয়ই।

No comments

Powered by Blogger.