হুমায়ুন ফরীদি-হারিয়ে গেল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

চলে গেলেন বাংলা নাট্য জগতের উজ্জ্বল তারকা হুমায়ুন ফরীদি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চ যে কয়জন নাট্যকর্মীর হাত ধরে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে, হুমায়ুন ফরীদি তাঁদেরই একজন। তাঁর এই মৃত্যু বাংলাদেশের নাট্য জগতে বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করবে। তাঁর এই মৃত্যুকে অকাল মৃত্যুই বলতে হয়। মাত্র ৬০ বছর বয়সেই পৃথিবীর মায়া কাটালেন হুমায়ুন ফরীদি। দেশের সংস্কৃতির আকাশ থেকে একটি নক্ষত্র যেন হারিয়ে গেল।


স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে নাট্যচর্চায় যে নতুন মাত্রা এসেছিল, হুমায়ুন ফরীদি সেই নবযাত্রার এক অগ্রসৈনিক। মঞ্চনাটক দিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু। এরপর একের পর এক কাজ করেছেন বিভিন্ন শাখায়। একসময় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন টেলিভিশনের অনিবার্য অভিনেতা হিসেবে। বাংলাদেশে টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটক 'সংশপ্তক'-এ 'কানকাটা রমজান' চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের আজও মনে থাকার কথা। মঞ্চে 'শকুন্তলা', 'কীত্তনখোলা', 'কেরামত মঙ্গল', 'মুনতাসীর ফ্যান্টাসি' ইত্যাদি নাটকে তাঁর হৃদয়গ্রাহী অভিনয় ভুলে যাওয়ার নয়। সংশপ্তকের পাশাপাশি টেলিভিশনে তাঁর অভিনীত নাটকগুলো দর্শকমনে দাগ কাটে। 'একাত্তরের যীশু', 'দহন', 'সন্ত্রাস', 'ব্যাচেলর', 'শ্যামল ছায়া' প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও সামাজিক ছবিতে দর্শকচিত্ত জয় করার মতো অভিনয় করেছেন তিনি। যেখানেই হাত রেখেছেন, সোনা ফলেছে। টেলিভিশন ও মঞ্চে নায়ক হিসেবেই অভিষেক হয়েছিল তাঁর। নায়ক, খলনায়ক ও পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। টেলিভিশনের পাশাপাশি দেশের মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও তিনি সাধারণ দর্শকদের হৃদয়ে স্থান করে নেন। বাংলা চলচ্চিত্রের দুর্দিনে হুমায়ুন ফরীদি অনেকটা ত্রাতার ভূমিকা নেন। খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করলেও তাঁর অভিনয় দেখার জন্য দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে যেতেন। মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি বিকল্প ধারার ছবিতেও উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল তাঁর। নিজেকে একজন অপরিহার্য অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। অভিনয়কে যে নিরাপদ পেশা হিসেবে নেওয়া যেতে পারে, সেটা প্রমাণ করেছেন হুমায়ুন ফরীদি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন যাঁরা, হুমায়ুন ফরীদি সেই বিশিষ্ট শিল্পীদের একজন। শিল্পীর অহং সবটুকুই ছিল তাঁর, আপস করেননি। বাংলা সিনেমার মূলধারায় অভিনয় করতে আসার পর আবার প্রতিবাদও করেছেন। যখন বাংলা সিনেমায় নোংরামি আর অশ্লীলতার জোয়ার, তখন প্রতিবাদ করেছেন ফরীদি।
হ্যাঁ, ফরীদিকে মনে রাখবে বাংলাদেশ। মনে রাখবে দেশের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। শকুন্তলার অর্ক কিংবা কীত্তনখোলার ছায়ারঞ্জনের ছায়া সহজে তো মুছে যাওয়ার নয়। যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো তাঁর অকাল প্রয়াণে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। এভাবে একটি চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া অভিনেতা সহজে পাওয়া যায় না। এমন একজন শিল্পীর জন্য অপেক্ষা করতে হয়, যেমন অপেক্ষা করতে হয়েছে হুমায়ুন ফরীদির জন্য।
পূর্ণপ্রাণ এই শিল্পীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

No comments

Powered by Blogger.