নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন-দলীয় অন্ধসমর্থকদের দিয়ে জয়লাভ সম্ভব নয় by আবদুল মান্নান

বিগত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাস দু-এক আগে খুব সকালে তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় গিয়েছিলাম আসন্ন নির্বাচনের কৌশল নিয়ে আলাপ করতে, আর নির্বাচনে তাঁর বিজয় নিয়ে আমার শঙ্কার কথা জানাতে। তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় চার দশকের। দুজনের মধ্যে সব সময় একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং বিশ্বাস করি, এখনো আছে।


দুজনে প্রায় দুই ঘণ্টা সেদিন আলোচনা করেছিলাম এবং তাঁকে আমার শঙ্কা ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলাম। সেদিন তিনি আমার কথা ধৈর্য সহকারে শুনেছেন, বিশ্বাস করেছেন কম এবং বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, এবার তিনি দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতবেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, তিনি দেয়ালের লিখন পড়তে ব্যর্থ হয়েছিলেন, ভোটারদের মতামত আগের মতো তাঁর পক্ষে থাকবে বলে ধরে নিয়েছিলেন এবং এ সত্যটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে বর্তমানে ভোটাররা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন; আর একান্তভাবে শুধু দলীয় প্রার্থী দিলেই যে তাঁকে দলের সব সমর্থক ভোট দেবেন, সেদিন সম্ভবত শেষ হয়ে এসেছে। সাধারণ জনগণের কাছে প্রার্থীর যদি গ্রহণযোগ্যতা না থাকে, তাহলে তাকে বিজয়ী হতে হলে ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় নিতে হবে।
চট্টগ্রামের সাবেক এই মেয়রের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী, সাধারণ জনগণের কাছে তিনি একজন জননেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং জাতির জনকের প্রায় সব গুণই তাঁর কাছে ছিল। তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল তাঁরই হাত ধরে রাজনীতিতে আসা একজন ওয়ার্ড কমিশনার মোহাম্মদ মন্জুর আলম, যিনি সবার কাছে একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত, প্রতিকূল পরিবেশেও নিজেকে সংযত রাখতে পারেন। তবে এটি একেবারে শতভাগ সত্য, চট্টগ্রামের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশনের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা তাঁর তখনো ছিল না এবং এখনো যে হয়েছে, তা মনে হয় না। সেই নির্বাচনে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রায় দুই লাখ ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। এই পরাজয় তাঁর স্তাবকদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও অনেকের কাছে তা স্বাভাবিক ছিল। পরাজয়ের পেছনে অনেক কারণ ছিল, যার অন্যতম হচ্ছে আওয়ামী লীগ পুরো পরিস্থিতি বুঝতে তখন অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে, দলে ভয়াবহ বিভক্তি এবং সর্বোপরি মহিউদ্দিন চৌধুরীর চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে পড়া। এই চাটুকারেরাই যে একজন জননন্দিত রাজনৈতিক নেতার পতন ত্বরান্বিত করতে পারে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন তার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এত দিন পর আমি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দুঃখজনক কিন্তু প্রত্যাশিত পরিণতি নিয়ে আলোচনা করতে বসিনি। এটি একটু পটভূমি হিসেবে লেখার শুরুতে ব্যবহার করলাম অনুষ্ঠেয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচন নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করার জন্য।
প্রথমে বলে নিই, সম্ভবত ১৯৬৯ সালের পর আমার আর কখনো নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার সুযোগ হয়নি এবং এই শহর বা জেলার রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তেমন জানা নেই। এই মেয়র নির্বাচনে যে তিনজন প্রার্থী বর্তমানে গণমাধ্যমে আলোচনার পাত্র, তাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় দূরে থাক, কখনো দেখাই হয়নি। তবে পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে এবং পরিচিত কয়েকজন নারায়ণগঞ্জবাসীর সঙ্গে কথা বলে তাঁদের অতীত কার্যকলাপ সম্পর্কে দেশের আর দশজন সচেতন মানুষের মতো আমারও তাঁদের সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে। তবে বর্তমানে যে তিনজন প্রার্থী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন, বাস্তবে আলোচনা বা বিতর্ক আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী শামীম ওসমান ও ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে। অন্য প্রার্থী বিএনপির তৈমুর আলম খন্দকারকে নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। কারণ, তিনি তাঁর দলের একক প্রার্থী এবং পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ আছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি বিআরটিসির চেয়ারম্যান ছিলেন। এখনো সাধারণ জনগণ ধরে নিয়েছে, বিএনপির সঙ্গে দুর্নীতির যে সম্পর্কটা সৃষ্টি হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছেদ্যই থেকে যাবে। বিগত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপির যে ভূমিধস পরাজয় তার অন্যতম কারণ, বিগত সময়ে দলটি দেশ শাসন করতে গিয়ে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছিল। আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট একটি ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করতে পেরেছিল। কারণ, নির্বাচনের সময় প্রার্থী মনোনয়নে শেখ হাসিনা অনেক বেশি যত্নশীল ছিলেন এবং যাঁদের গায়ে গডফাদার বা দুর্নীতির লেবেল লাগানো ছিল, তাঁদের সবাইকে না হলেও বেশির ভাগকেই মনোনয়ন থেকে দূরে রাখতে পেরেছিলেন। সেই নির্বাচনে তিনি অনেক নতুন মুখ, যাঁদের একটা ক্লিন ইমেজ আছে—শিক্ষিত, মার্জিত ও রুচিশীল—তাদের মনোনয়ন দিয়েছিলেন এবং এ কারণে সব মহলে তিনি বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন। তিনি মন্ত্রিসভা গঠনেও অনেক নতুন মুখ উপহার দিয়েছিলেন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নারীদের কাছে অর্পণ করে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছিলেন। এসব ছিল তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিনবদলের’ সনদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সরকার গঠনের পর সারা দেশে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নামধারী কিছু অর্বাচীন যুবক সন্ত্রাসের নতুন মাত্রা যোগ করলে তিনি তা কঠিন হাতে দমন করার চেষ্টা করেছিলেন। অনেকের হয়তো দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে, এবার নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য শেখ হাসিনার নাম শর্ট লিস্টেডও হয়েছিল। এবার তিনি শান্তি পুরস্কার না পেতে পারেন, কিন্তু শর্ট লিস্টেড হওয়া একধরনের স্বীকৃতি।
এবার ফিরে আসি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রসঙ্গে। এটি ঠিক, এ নির্বাচন একটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন এবং তা দলীয়ভাবে হয় না। চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে প্রায় শুরু থেকেই নাগরিক কমিটির ব্যানারে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী নির্বাচনে লড়েছেন। যে ব্যানারেই লড়ুন না কেন, তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অথবা সভাপতি। নির্বাচন কমিশন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার আগে এ নির্বাচনে নিজ প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাতে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধীদলীয় নেতা—সবাই চট্টগ্রাম এসেছেন। কিন্তু এখন তা নিষেধাজ্ঞার কারণে সম্ভব নয়। নারায়ণগঞ্জের ক্ষেত্রে এমন কোনো ব্যানার না থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে এটি আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপির লড়াই। আওয়ামী লীগের দুজন আর বিএনপির একজন। নারায়ণগঞ্জের বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হয়েছে, এই নির্বাচনে দলীয় পরিচয়ের বাইরে ব্যক্তির ইমেজ একটি বড় ফ্যাক্টর। একেবারে যাঁরা দলকানা, তাঁরা ছাড়া দলীয় প্রার্থীরা গ্রহণযোগ্য না হলে সাধারণ মানুষের সহজে সমর্থন পান না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে প্রচারণা চালানোর সময় এটা লক্ষ করা গেছে, অনেক দলকানা আওয়ামী লীগ-সমর্থকও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, যেহেতু বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দিতে পারি না এবং যেহেতু নাগরিক কমিটির প্রার্থীও আমাদের পছন্দনীয় নয়, সেহেতু নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রেই যাব না। অনেকেই তাঁদের কথা রেখেছিলেন। আমার এক পরিচিত জন তো তাঁর ব্যবসা বন্ধ করে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন এবং রাতে নাগরিক কমিটির প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয়ের খবর শুনে বেশ পুলকিত হয়েছিলেন।
শামীম ওসমান ও আইভী দুজনই নারায়ণগঞ্জের নামকরা রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। শামীম ওসমানের বাবা শামসুজ্জোহা নারায়ণগঞ্জ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি একজন ত্যাগী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর ছেলেরা বাবার সেই সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে পারেননি। এখানকার মানুষের কাছে তাঁদের ইমেজ গডফাদারের। কেউ বলেন, সব ভাই মিলে নারায়ণগঞ্জে ওসমানি শাসনামল চালু করেছেন। সেই শাসনামলে দলীয় সন্ত্রাসীরা ভালো থাকলেও সাধারণ মানুষের শান্তি হারাম হয়ে গেছে। শামীম ওসমান বিগত বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশছাড়া ছিলেন।
অন্যদিকে আইভীর বাবা আলী আহাম্মেদ চুনকা এই জেলায় একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে আজীবন জড়িত ছিলেন। প্রবাস থেকে এসে অত্যন্ত বৈরী পরিবেশে তিনি জনগণের সমর্থনে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই পদে তিনি আট বছর দায়িত্ব পালন করেন এবং নারায়ণগঞ্জের উন্নতির জন্য কোনো দুর্নাম কুড়ানো ছাড়াই পৌর এলাকার সার্বিক উন্নয়নের চেষ্টা করেন।
ধারণা করা হয়েছিল যে দল সার্বিক বিষয় বিচার করে ডা. আইভীকেই মনোনয়ন দেবে। দলের শীর্ষপর্যায় থেকে একটি সমঝোতার চেষ্টা করা হয়েছিল, যা কাজ দেয়নি। অনেকে মনে করেন, এখানে শেখ হাসিনার দিনবদলের সনদের কথা মনে রাখলে সমঝোতার কোনো বিষয় ছিল না। শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতা হয়নি এবং বর্তমানে দুজনই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। শামীম ওসমান দাবি করেছেন, তিনি হচ্ছেন দলের আসল প্রার্থী। কারণ, দলের তিন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক তাঁর তাঁবুতে গিয়ে তাঁদের সমর্থন দিয়ে এসেছেন। মাহবুব উল হানিফ বলেছেন, দল আর কাউকে সমর্থন দেয়নি। উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও বলেছেন, এ নির্বাচনে দলীয়ভাবে সমর্থন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলায় দলের মধ্যে আত্মঘাতী বিভক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যেমনটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অবদান এখন দেশের বাইরেও স্বীকৃত। এই স্বীকৃতির অংশ হিসেবে তিনি সম্প্রতি অত্যন্ত মর্যাদাবান সাউথ সাউথ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এসবের প্রেক্ষাপটে নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে তাঁর কোনো দ্বিধা থাকা উচিত ছিল না। এখন মনে হচ্ছে, তাঁর দ্বিধাই শুধু আছে না, এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের পরবর্তী পদক্ষেপও প্রশ্নবিদ্ধ। সবাই আশা করে, আগের অনেক সংকট প্রধানমন্ত্রী এককভাবে যেমনটি মোকাবিলা করেছেন, এবারও এ ক্ষেত্রে তাঁর যথাযথ হস্তক্ষেপ তিনি করবেন এবং সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো নতুন বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়া থেকে তিনি নিজ দলকে রক্ষা করবেন। মনে রাখতে হবে, আমরা এখন সচেতন জনগণকে নিয়ে হিসাব করছি। দলীয় অন্ধসমর্থকদের ওপর নির্ভর করে নির্বাচনে জয়লাভ করার দিন শেষ হয়ে এসেছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে শুরু করেছিলাম। এই জেলার, বিশেষ করে মহানগরের রাজনীতির হালহকিকত নিয়ে শেষ করতে চাই। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থান যা ছিল, বর্তমানে তা আরও খারাপ হয়েছে। সামনের নির্বাচনের আগে তা যদি ঠিক না হয়, তাহলে পরিস্থিতি খুব বেশি সুখকর হবে না। এখানেও দলীয় সভানেত্রীর হস্তক্ষেপের কোনো বিকল্প দেখি না। কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.