স্মরণ-হেনা দাস : নারী ও শিক্ষক আন্দোলনের অগ্নিকন্যা by নার্গিস হোসনে আরা

শিক্ষক আন্দোলনের অগ্রণী নেত্রী হিসেবেই অনেকে জানেন তাঁকে। কিন্তু বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই তাঁর ভূমিকা অসাধারণ। কৃষক-শ্রমিক, শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি পালন করেন অগ্রণী সংগঠকের ভূমিকা। নারীনেত্রী হিসেবে এ দেশে নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আজীবন নিয়োজিত ছিলেন তিনি। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও পালন করেন সংগঠকের ভূমিকা। আজীবন সংগ্রামের সঙ্গেই নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন হেনা দাস। জন্মেছিলেন এমন এক সমাজে, যে সমাজ নারীকে মর্যাদা দিতে জানত না। নারী প্রগতি, নারী আন্দোলন_এসব ধারণা দূরস্থ, নারী শিক্ষা নিয়েও বোধ হয় তখন কারো ভাবনা ছিল না। সেই পশ্চাৎপদ সমাজে ১৯২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি হেনা দাসের জন্ম সিলেটে। আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন কৈশোরেই। যুক্ত হন বাম রাজনীতির সঙ্গে। সেটা ১৯৩৮ সাল। ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হিসেবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর ছাত্রীদের সংগঠন গড়ে তোলার কাজে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাঁর। ১৯৪২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। শুরু হয় তাঁর আরেক জীবন। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভের পর গড়ে তোলেন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। গণনাট্য সংস্থায় যোগ দেন একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে। দলের কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে আত্মগোপন করতে হয় তাঁকে। এরই মধ্যে ১৯৪৭ সালে তিনি বিএ পাস করেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ই ১৯৪৮ সালে রোহিনী দাসের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। উল্লেখ্য, দুজনই তখন আত্মগোপনে ছিলেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় নানকার বিদ্রোহে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন তিনি। এরপর সিলেটের চা বাগানগুলোতে নারী শ্রমিকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব পান তিনি। নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শরিক হন তিনি। গড়ে তোলেন চা বাগানের নারী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন।
১৯৫৮ সালে আত্মগোপন ছেড়ে প্রকাশ্যে আসেন হেনা দাস। পেশা হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতা। বিএড ডিগ্রি অর্জনের পর যোগ দেন নারায়ণগঞ্জ স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে। শুরু হয় শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ গঠিত হলে হেনা দাস মহিলা পরিষদের সদস্য হন। কবি সুফিয়া কামালের মৃত্যুর পর তিনি এই সংগঠনের সভানেত্রীর দায়িত্ব পান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বাংলাদেশের শিক্ষকদের তিনি সংগঠিত করেন। কলকাতার শিক্ষকদের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আলোচনা করেন। গড়ে তোলেন ৫০টি ক্যাম্প স্কুল। স্বাধীনতার পর ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশনেরও সদস্য ছিলেন তিনি।
দীর্ঘ সাত দশকের সংগ্রাম শেষ হয় ২০০৯ সালের ২০ জুলাই ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও অতৃপ্তি ছিল তাঁর। বলেছিলেন, 'আজীবন যুদ্ধই করে গেছি। এ সমাজ সেই সমাজ নয়, যে সমাজের স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম। অনেক যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছি। কিন্তু আরো অনেক যুদ্ধ করতে হবে। অনেক কিছুই এখনো অর্জন করতে বাকি।' নানা কাজের অবসরে লেখালেখিও করতেন। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আছে, 'আমার শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবন', 'স্মৃতিময় দিনগুলো', 'স্মৃতিময় একাত্তর', 'পঞ্চম পুরুষ' ও 'চার পুরুষের কাহিনী'। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মহীয়সী নারীকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
নার্গিস হোসনে আরা

No comments

Powered by Blogger.