বিশ্ব খাদ্য দিবস-খাদ্যঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানোর পথ by ফরিদা আখতার

খাদ্যের দাম বাড়ছে, এ নিয়ে বিতর্কের নতুন কিছু নেই। আমাদের দেশে চালের দাম দিয়ে সব রাজনীতি হয়। নির্বাচনের আগে ও পরে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের সুর জায়গামতো পাল্টে যায়। আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতির পাল্টাপাল্টি হয়, কিন্তু চালের দাম কমে না। কৃষকও তার উৎপাদিত ফসলের মূল্য পায় না। কষ্ট পায় গরিব মানুষ।


দুই বেলা ভাত খাওয়ার জন্য তাদের যে পরিমাণ খাটাখাটনি করতে হয়, সেটা চরম নিষ্ঠুর মনে হয়। পোশাকশ্রমিক যখন বেতন বাড়ানোর জন্য দাবি তোলে, তখন কোনো শখ-আহ্লাদ করার জন্য নয়, তাদের দাবির পক্ষে সঠিকভাবেই ক্রমবর্ধমান খাদ্যের দামটাই প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। বেতন যতই বাড়ুক, সব ক্ষেত্রেই খাদ্যের দাম তা খেয়ে ফেলে। শ্রমিকের বেলায় কষ্টটা হয় অনেক বেশি। বাজারে চালের দাম সর্বনিম্ন ২৯-৩০ টাকা কেজি (যা ওএমএসে ২৪ টাকায় বিক্রি হয়), আর একটু ভালো চাল হলে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত দাম ওঠে। ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য, তাই চালের দামের কথা বলেই ক্ষান্ত দিচ্ছি। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে ভাতের সঙ্গে কমপক্ষে একটি তরকারি এবং ডাল লাগে। তাল মিলিয়ে সেসব খাদ্যের দামও বাড়ছে। চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ২০১১ সালের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে খাদ্যের উচ্চমূল্যের বিষয়টি নির্ধারণ করেছে। কারণ, এ কথা আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলে উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলো যতই আশ্বাস দিক, খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে গেলে তা অর্জন করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হবে। বিশ্বব্যাংক হিসাব কষে বলছে, ২০১০-২০১১ সালে খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে প্রায় সাত কোটি মানুষ অতি দরিদ্র পর্যায়ে নেমে গেছে। তাই এ বছর বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে, যেন বিশ্বের গরিব দেশগুলোর জন্য কিছু করা যায়। যদি তা-ই হয়, তাহলে সাধুবাদ জানাচ্ছি।
কিন্তু মনে হয় বিশ্বনেতাদের এই উপলব্ধি হতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রাক্কালে অক্টোবরের ১১ তারিখে ওয়াশিংটনে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি ইনস্টিটিউট (IFPRI) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যমূল্য কমানোর জন্য আহ্বান জানিয়ে বিশ্বের গরিবদের ক্ষুধার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে আফ্রিকার গরিব মানুষ চরম খাদ্যসংকটের মধ্যে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। [http://www.ifpri.org/publication/2010-global-hunger-index]
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (Global Hunger Index) নামের এই প্রতিবেদনে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন, জৈব জ্বালানি উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান চাহিদাসহ আন্তর্জাতিক বাজারের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে ২০০৭-২০০৮ সালে জৈব জ্বালানির জন্য খাদ্যশস্যের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী তীব্র খাদ্যসংকটের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। অর্থাৎ খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হচ্ছে মানুষের জন্য নয়, গাড়ির জন্য।
বলাই বাহুল্য, খাদ্যসংকট ক্ষুধা সৃষ্টি করে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স সেই দিক থেকে বিবেচনা করে তিনটি মানদণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে জানাচ্ছে, বিশ্বের ২৬টি দেশে ক্ষুধার চরম অবস্থা চলছে। তিনটি মানদণ্ড হচ্ছে—পুষ্টিহীন মানুষের অনুপাত, পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে স্বল্প ওজনের শিশুদের অনুপাত এবং শিশুমৃত্যুর হার। এসব মানদণ্ডে আফ্রিকার চারটি দেশ বুরুন্ডি, ইরিত্রিয়া, শাদ ও কঙ্গোতে ৬৩% হয়েছে। এসব দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ পুষ্টির দিক থেকে খুব খারাপ অবস্থায় আছে। জাতিসংঘের অন্য একটি প্রতিবেদনেও খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্ষুধা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এবং বলা হচ্ছে, গরিব দেশে খাদ্যশস্যের দাম বাড়ছে এবং ২০১২ সালেও এই প্রবণতা থাকবে।
বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের দাম বাড়ার আরেক নতুন কারণ যোগ হয়েছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। খাদ্য এখন বাণিজ্যের জন্য খুব লাভজনক। বিনিয়োগকারীরা এখন খাদ্যশস্য, বিশেষ করে ভুট্টা, সয়াবিন ও গমের ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের ওপর বাজি রাখছে। ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের হার দ্রুতগতিতে বাড়ছে; ২০০৩ সালে ছিল মাত্র ১৩ বিলিয়ন ডলার, ২০০৮-এ এসে তা হয়েছে ২৬০ বিলিয়ন ডলার, পাঁচ বছরে প্রায় ১৯০০% বেড়ে গেছে, বছরে ৩৮০%। এই বিনিয়োগ অত্যন্ত বেশি পরিমাণে হচ্ছে; গমের বেলায় দেখা যাচ্ছে, গম যা উৎপাদিত হচ্ছে তার চেয়ে তিন গুণ বেশি বিনিয়োগ করার জন্য তৈরি আছে। যদিও তারা সত্যিকার অর্থে কেনে না, কিন্তু তাদের এই বিনিয়োগের প্রভাব বাজারের ওপর নেতিবাচকভাবে পড়ে। উৎপাদিত খাদ্যশস্যের মাত্র ১০% আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মধ্যে আসে, তা সত্ত্বেও এই বাজারের প্রভাব অনেক বেশি। দুঃখজনক হচ্ছে, বিভিন্ন দেশের সরকার রপ্তানিমুখী কৃষি উৎপাদন এবং গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনগুলোকেই সহায়তা দেয়, অন্যদিকে নিজ দেশের স্থানীয় বাজার এবং উৎপাদনে গুরুত্ব দেয় না।
খাদ্যশস্যের ওপর বিনিয়োগে এত আগ্রহের কারণ ক্ষুধা মেটানো নয় মোটেই। এটা হচ্ছে বায়ো-ফুয়েল বা জৈব জ্বালানির চাহিদার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বায়ো-ফুয়েল উৎপাদনে ভর্তুকি দিচ্ছে, ফলে ভুট্টার মতো খাদ্য-ফসল যা অনেক দেশের মূল খাদ্য, তা মানুষের খাবার টেবিলে না এসে চলে যাচ্ছে গাড়ির তেল উৎপাদনের জন্য। বিশ্বব্যাপী বায়ো-ফুয়েলের ভর্তুকির পরিমাণ ২০০৯ সালে ২০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে যত বেশি বায়ো-ফুয়েলের চাহিদা বাড়ছে, ততই খাদ্যশস্য খাদ্য হিসেবে না এসে গাড়ির তেল হয়ে যাচ্ছে এবং খাদ্যঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। দামও বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে। এই প্রতিবেদনের শেষে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, দেশের মানুষকে খাওয়াতে পারে এমন কৃষির ওপর জোর দিতে হবে এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের খাদ্য উৎপাদনে সহযোগিতা করতে হবে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স অনুযায়ী বাংলাদেশে চার কোটি ১৪ লাখ মানুষ অপুষ্টির শিকার, যা মোট জনসংখ্যার ২৬%। অর্থাৎ প্রতি চারজনের একজন পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এই হার উদ্বেগজনক।
শুরুতেই বলেছি বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে, যা মানুষের জন্য বহন করা কঠিন হয়ে উঠছে দিনে দিনে। খাদ্যশস্যের দাম বাড়তে থাকলে পুষ্টিহীনতা আরও বাড়বে সন্দেহ নেই। অথচ এ দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো কঠিন নয়। এ দেশে ক্ষুদ্র কৃষকদের সংখ্যা মোট কৃষক পরিবারের ৮৪%। কাজেই তাদের কেন্দ্র করে কৃষি পরিকল্পনা করলে কৃষকেরা নিজেরাও বাঁচবে, দেশের খাদ্যেরও জোগান দিতে পারবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় এখন ক্ষুদ্র কৃষকদের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার বিষয়টি চলে আসছে।
অথচ আমাদের কৃষি বা খাদ্য উৎপাদন পরিকল্পনা বলে কিছু আছে বলে মনে হয় না। খাদ্যের জমিতে আবাসন গড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে, ধানের জমিতে ইটের ভাটা, রবি ফসলের মৌসুমে তামাক চাষ করে খাদ্যের বিশাল ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে, অথচ সরকার শক্তভাবে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। উৎপাদনের স্বল্পতা ঘটলে সরকারকে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণে খাদ্য আমদানি করতে হয় এবং বিশ্ব খাদ্যমূল্যের খপ্পরে পড়ে যায়। জৈব জ্বালানির ব্যাপার বাংলাদেশে এখন কতখানি আছে সরকারিভাবে বলা হচ্ছে না, কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আখ চাষ করে জৈব জ্বালানির চুক্তি হয়েছিল বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে নিত্যনতুন হাইব্রিড ধান ও জিএম ধান প্রবর্তন করে কৃষকের ক্ষতি করছে। ঝলক ধান, নেরিকা ধান সাম্প্রতিক সময়ের বড় উদাহরণ। কৃষক প্রতারণার শিকার হচ্ছে বলে পত্রপত্রিকায় জানা যাচ্ছে।
খাদ্যঘাটতি দূর করার অনেক উপায় আছে। আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, খাদ্য-ফসলের জমিতে অন্য ফসল উৎপাদন, বিশেষ করে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করে খাদ্য-ফসলের চাষ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম দিয়ে তাকে টিকে থাকতে সহায়তা করা।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.