পুরান ঢাকা-ঢাকার বন্ধকি ভাড়াটে by মযহারুল ইসলাম

মর্টগেজ ভাড়াটে বা বন্ধকি ভাড়াটে নামক শব্দের সঙ্গে আমাদের পূর্বপরিচয় নেই। শোনামাত্র চমকে উঠেছি। এ আবার কেমনতর ভাড়াটে! যার নামের আগে মর্টগেজ বা বন্ধকি শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সনাতনি অভিজ্ঞতা হচ্ছে, মাসিক ভাড়া প্রদান সাপেক্ষে মানুষ বাড়ি-ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করে থাকে। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা জামানত বাবদ অগ্রিম অর্থ বাড়ির মালিকদের প্রদানেরও বিধান আছে। অগ্রিম অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে হেরফের হয়ে থাকে।


কারও ক্ষেত্রে তিন মাসের ভাড়ার অগ্রিম, কারও ক্ষেত্রে দু-এক মাসের। ঢাকা শহরের বাড়ির বা ফ্ল্যাটের মালিকদের চেয়ে ভাড়াটের সংখ্যাই অধিক। এ বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই। আমাদের বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটেদের সনাতনি ব্যবস্থায় মর্টগেজ ভাড়াটে নতুন সংযোজন। আমি বিষয়টি বিস্তারিত জানতে আগ্রহী হয়ে মর্টগেজ ভাড়াটে ও বাড়িওয়ালা উভয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। জেনেছি চমকপ্রদ অভিনব ব্যবস্থাটি।
ব্যবস্থাটি বিগত তিন-চার বছর ধরে পুরান ঢাকায় চালু হয়েছে এবং ক্রমেই এর দ্রুত বিস্তার ঘটেছে। পুঁজির শক্তি ও পুঁজির ক্ষমতা এতে প্রকটভাবেই ফুটে উঠেছে। বাড়িওয়ালাদের অর্থের প্রয়োজন মেটাতেই মর্টগেজ ভাড়াটে-ব্যবস্থাটি চালু হয়েছে। বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিকদের তিন বা পাঁচ লাখ টাকা একত্রে প্রদান করে মর্টগেজ ভাড়াটে বাড়ি বা ফ্ল্যাটে ওঠে। ব্যবহূত গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির বিলই তারা কেবল পরিশোধ করে। মাসিক কোনো ভাড়া তাদের দিতে হয় না। একসঙ্গে নগদ তিন বা পাঁচ লাখ টাকা প্রদানের কারণেই বিনে ভাড়ায় বসবাসের এমন ব্যবস্থা। রীতিমতো দলিল-দস্তাবেজ করেই পরস্পর চুক্তিবদ্ধ হয়। তিন বা পাঁচ বছর মেয়াদে সাধারণত চুক্তি হয়ে থাকে। চুক্তির সময়সীমা অতিক্রমের পর বাড়িওয়ালাকে শুরুতে দেওয়া তিন বা পাঁচ লাখ টাকা মর্টগেজ ভাড়াটেকে একত্রে ফেরত দিতে হয়। অর্থাৎ চুক্তির মেয়াদকাল পর্যন্ত মর্টগেজ ভাড়াটে বিনে ভাড়ায় থাকবে। কেবল গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল পরিশোধ করবে। চুক্তির মেয়াদ শেষে লগ্নির পুরো টাকা একত্রে ফেরত নেবে। কোনো কারণে বাড়িওয়ালা অর্থ ফেরত দিতে অক্ষম হলে, তাদের মধ্যে পুনরায় নতুন করে চুক্তিপত্র সম্পাদন করে আগের নিয়মেই ফ্ল্যাটে বা বাড়িতে বিনে ভাড়ায় বসবাস করতে পারবে।
নগদ অর্থের তাগিদেই নিরুপায় বাড়ির মালিকদের এমন চুক্তি করতে হয়। পুরান ঢাকার জায়গা বাড়েনি, কিন্তু বেড়েছে পরিবার। পৈতৃক সম্পত্তিতে অংশীদারদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারায় কারও মালিকানার জায়গার পরিমাণ আধা কাঠা থেকে সোয়া কাঠার ঊর্ধ্বে নয়। খুব কমসংখ্যক আছে, যাদের জমির পরিমাণ তিন-চার কাঠা। সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের জায়গার পরিমাণ আধা কাঠা থেকে সোয়া কাঠা হওয়ার কারণেই এই স্বল্প জায়গায় রাজউকের অনুমোদন পাওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়া আছে সরু রাস্তার জন্য রাজউকের অনুমোদন না দেওয়ার পাকা ব্যবস্থা। রাজউকের অনুমোদন লাভের ক্ষেত্রে আরেক অন্তরায় বাড়ি নির্মাণে চারদিকে জায়গা ছেড়ে বাড়ি নির্মাণের শর্তারোপ, যা পুরান ঢাকার জমির মালিকদের ক্ষেত্রে পালন অসম্ভব। আধা কাঠা থেকে সোয়া কাঠা জায়গার চারদিকে জায়গা ছাড়লে তো বাড়ি নির্মাণের ন্যূনতম জায়গাও থাকে না। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বল্প জায়গার মালিকেরা রাজউকের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে স্বউদ্যোগে জীবনের সব সঞ্চয় বিনিয়োগ করে বাড়ি নির্মাণে হাত দেয়। রাজউকের অনুমোদন না থাকায় তাদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় বা বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহনির্মাণ ঋণ পাওয়াও সম্ভব হয় না। নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে অগত্যা তাদের মর্টগেজ ভাড়াটেদের শরণাপন্ন হতে হয়। তিন বা পাঁচ লাখ নগদ টাকা গ্রহণ করে মর্টগেজ ভাড়াটেদের ঘর-ফ্ল্যাট বিনে ভাড়ায় দিতে হয়। পুরান ঢাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বল্প জমির মালিকদের একই দশার কারণে মর্টগেজ ভাড়াটে ব্যবস্থাটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে চলেছে। খুব কমসংখ্যকই ব্যক্তিগত ও পরিবারিক অর্থের প্রয়োজন মেটাতে মর্টগেজ ভাড়া দিয়ে থাকে। একজন জানিয়েছেন, মেয়ের বিয়ের পণের অর্থ প্রদানের জন্য বাধ্য হয়ে নিজেদের দুই রুম মর্টগেজ ভাড়া দিয়ে ছাদে টিনশেডের ঘর তুলে নিজেরা বসবাস করছে। মর্টগেজ ভাড়াটেরাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে যে বাড়ির মালিকদের নগদ অর্থের প্রয়োজন মেটানোর সুযোগটি তারা কাজে লাগিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে। টাকাই টাকা তৈরি করে। ব্যাংকের সুদও এত অধিক নয়। ব্যবসায় বিনিয়োগে নানা ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি নেই। নিরাপদ লাভজনক বিনিয়োগই তারা মনে করে।
সাধারণত ভাড়াটেদের ওপর বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতার নানা অভিযোগ আছে। তবে মর্টগেজ ভাড়াটেদের তেমন কোনো অভিযোগ নেই বরং তারা অধিক সমীহ ও মর্যাদা বাড়িওয়ালাদের থেকে পেয়ে থাকে। বাড়িওয়ালাদের আর্থিক দুরবস্থার এই সুযোগ নেওয়া নৈতিক কি না! জানতে চাইলে বলে, ‘একজন নিরুপায় বাড়ির মালিককে অর্থ দিয়ে উপকার করেছি। বিনিময়ে নিজেরাও লাভবান হচ্ছি। এখানে অনৈতিক কিছু নেই। বরং আমরা অর্থ না দিলে তাদের পক্ষে বাড়ি নির্মাণের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করা সম্ভবপর ছিল না। আর তারা মাথা কুটলেও রাজউকের অনুমোদন না থাকার কারণে আর্থিক কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে একটি টাকাও ঋণ পাবে না। নিজেরা লাভবান হচ্ছি সত্য, তাই বলে বাড়ির মালিকও যে লাভবান হচ্ছে না, তাও অসত্য নয়।’
দেশজুড়ে সর্বত্র চলছে পুঁজির দৌরাত্ম্য। পুঁজির নীরব শোষণও। পুঁজির শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র ক্রমেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার করে চলেছে। বর্তমান ব্যবস্থায় এর থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। বিকল্প ব্যবস্থা না আসা পর্যন্ত হরেক ক্ষেত্রে পুঁজির দৌরাত্ম্য আমাদের দেখতে হবে এবং ভুগতেও হবে।
মযহারুল ইসলাম: লেখক-গবেষক, পুরান ঢাকার বাসিন্দা।

No comments

Powered by Blogger.