বন্যা, নদীভাঙন ও জলাবদ্ধতা-দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা নিন

ঘর-পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, তেমনি বর্ষা এলেই রাজধানীর বাসিন্দারা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এই বুঝি ভয়াবহ জলাবদ্ধতা শুরু হলো। রাস্তায় নেমে এল ডিঙি নাও। ময়লা-আবর্জনার পূতিগন্ধময় পরিবেশে হাঁটুপানি ভেঙে চলাচল, বসবাস_সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।
ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এ সময় কানে তুলা ঠেসে রাখে। তারপর বর্ষা পেরোলে কানের তুলা খুলে উন্নয়নের শানাই বাজাতে থাকে। কিন্তু কেবল রাজধানী নয়, গোটা বাংলাদেশের জন্যই যে এক ভয়াবহ দুঃসময় এগিয়ে আসছে, তা নিয়ে আমরা কতটা ভাবছি? গতকালের (২১ জুলাই) পত্রিকায়ও সেই দুঃসময়ের অনেক পূর্বাভাস রয়েছে। মাত্র তিন দিনের বৃষ্টিতেই কঙ্বাজারে দেড় লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানে যানচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। মাসখানেক আগেও কঙ্বাজারসহ গোটা উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। ভোলা, পটুয়াখালী ও সংলগ্ন এলাকায় ক্রমেই চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গতকালের কালের কণ্ঠে প্রকাশিত আরো দুটি খবর হচ্ছে, 'ছোট হয়ে আসছে লালমোহন' এবং 'হঠাৎ রুদ্র রূপে আড়িয়াল খাঁ'। দুটি খবরই নদীভাঙনের তীব্রতা নিয়ে। লালমোহন উপজেলার ১০টি স্থানে মেঘনার ভাঙন তীব্র রূপ নিয়েছে। বিস্তর আবাদি জমি, ঘরবাড়ি ইতিমধ্যেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ফরিদপুরে আড়িয়াল খাঁ নদের ভাঙনে একটি স্কুলঘরসহ দেড় শতাধিক একর আবাদি জমি বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অববাহিকার সর্বত্রই কমবেশি একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। অথচ যাঁরা ক্ষমতাসীন, যাঁরা এ ব্যাপারে কিছু করতে পারেন অথবা দেশ যাঁদের হাতে এসব প্রতিকারের দায়িত্ব দিয়েছে, তাঁরা একেবারেই নিশ্চিন্তে আয়েশি দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরা লালমোহনের আশ্রয়হীন মানুষের বুকফাটা আর্তনাদও শুনতে পান না। শোনা যায়, তাঁদের কেউ কেউ মোহনায় চর জেগে ওঠার এবং সাগর ভরাট হয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের আয়তন বেড়ে যাওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখছেন। তাঁদের উদ্দেশে কিছু বলার ক্ষেত্রেও রুচির বাধা অনুভব করি।
উপদেশ খয়রাত আর অন্যকে দোষারোপ করাটা আমাদের মজ্জাগত। ডিসিসির এক কর্মকর্তা জলাবদ্ধতার জন্য নাগরিকদের দোষারোপ করেছিলেন। তাঁর মতে, যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা, গৃহস্থালি ও অন্যান্য বর্জ্য স্তূপ করে রাখা হয়। বৃষ্টিতে ধুয়ে সেগুলো গিয়ে ড্রেন ভরাট করে ফেলায় বৃষ্টির পানি নামতে পারে না এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তাঁর কথা হচ্ছে, নাগরিকদের কোনো দোষ নেই তা আমি বলছি না। নির্ধারিত স্থানে ময়লা না ফেলে তার পাশেই ময়লা ফেলে যান অনেকে। তাঁর কথার পরিপ্রেক্ষিতে নগরবাসীর প্রশ্ন, সেই নির্ধারিত স্থান কি পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে পেরেছে ডিসিসি? সেগুলো উপচে পড়লেও ময়লা ঠিকমতো সরানো হয় কি? গত ১০ বছরে কি ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়েছে? বাস্তবতা হচ্ছে, নগরের বাসিন্দা প্রতিটি পরিবারে প্রতিদিন গৃহস্থালি বর্জ্য হবেই। সেগুলো কোথাও না কোথাও ফেলতে হবে, ঘরে জমিয়ে রাখা যাবে না। ঢাকা শহরে প্রতিদিন যে বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তার অর্ধেকও ঠিকমতো সরানোর ক্ষমতা কি ডিসিসির আছে? এ অব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কে নেবে?
সরকার ও সংস্থাগুলোর কর্ণধারদের প্রতি অনুরোধ, দয়া করে কেবল অজুহাত ও উপদেশ দেবেন না। হাইকোর্টের প্রদত্ত নির্দেশনার কথাগুলো বিবেচনা করুন। নদীর সীমানা নির্ধারণ ও নদীখননের উদ্যোগ নিন। পাশাপাশি ঢাকার পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন করুন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতিকে আমলে নিয়ে দুর্গত মানুষকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিন। কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। এখন উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে হয়তো প্রতিকার অসম্ভব হয়ে পড়বে। তখন আপনাদের ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের দায়ভার বহন করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.