নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-নিয়তির বিধান এবং পাথরঘাটার তুচ্ছ ঘটনা by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী বিধান বড়ুয়া সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছেন। দীর্ঘ ছয় বছর কাতারে প্রবাস জীবন কাটিয়ে গোপনে দেশে ফেরার পর র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েন তিনি। কথা হচ্ছে, যাঁর বিরুদ্ধে অন্তত তিনটি হত্যাসহ ২১টি মামলা আছে এবং একটি মামলায় সাজাও হয়েছে ২০ বছরের, তিনি হঠাৎ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে এলেন কেন? নিজ দলের


সরকার ক্ষমতায় থাকলে অনেকেই মামলা-মোকদ্দমা-দণ্ডকে থোড়াই কেয়ার করেন, আত্মগোপনের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন দাপটে। এই দাপটের পেছনে থাকে দলীয় নেতা বা গডফাদারের অভয়বাণী। কিন্তু বিধানের দল তো এখন ক্ষমতায় নেই, এমনকি তাঁর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ঘুরেফিরে যাঁর নাম উঠে আসছে পত্রপত্রিকায়, বিএনপির সেই নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও তো এখন জেলে। তাহলে কার ভরসায়, কী উদ্দেশ্যে দেশে ফিরলেন তিনি?
বিধান বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক নেতার জন্য নয়, মা-বাবা ও স্ত্রীর টানেই তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরে এসেছেন। খুন করতে যাঁর হাত কাঁপে না, অনেক মা-বাবা-স্ত্রী-সন্তানের সারা জীবনের কান্নার উপলক্ষ হয়ে আছেন যে লোকটি, তিনি হঠাৎ নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে মা-বাবা ও স্ত্রীর জন্য এতটা অধীর ও কাতর হয়ে উঠবেন—এ কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
র‌্যাব বলছে, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার জোরে ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরেছেন বিধান। কোনো অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পুরোনো সহযোগীদের সংগঠিত করার পরিকল্পনাও তাঁর ছিল বলে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা স্বীকার করেছেন বিধান। তবে, সেই ঘনিষ্ঠতাকে বলেছেন ‘অতীত অধ্যায়’। এখনো তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক আছে কি না—সাংবাদিকদের এ রকম প্রশ্নের যে উত্তর তিনি দিয়েছেন, তা যেন প্রায় দার্শনিকতার পর্যায়ে উন্নীত। বলেছেন, ‘হ্যাঁ বললেও দোষ, না বললেও বিপদ। হ্যাঁ বললে মরতে হবে, না বললে যেতে হবে জেলে।’
এ কথার মধ্যেই হয়তো নিহিত আছে সন্ত্রাসীদের জন্য নিয়তির বিধান।
আশির দশকে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান আকতার হোসেন ওরফে রাজুর হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলেন বিধান বড়ুয়া। কিন্তু একটি চুরির ঘটনায় চেয়ারম্যান তাঁকে শাস্তি দিলে ক্ষুব্ধ হয়ে দল ত্যাগ করেন তিনি। যোগ দেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল জাতীয় পার্টিতে।
এরপর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) গঠন করলে সেই দলে যোগ দেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আশ্রয় পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বিধান। নিজের নামে সন্ত্রাসী বাহিনী (বিধান বাহিনী) গড়ে তুলে পুরো রাউজান এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। ১৯৯৩ সালে তাঁর হাতে খুন হন তাঁর প্রথম রাজনৈতিক গুরু ইউপি চেয়ারম্যান আকতার হোসেন (রাজু)।
পরবর্তী এক দশকে তাঁর বাহিনীর হাতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের এক ডজনের বেশি নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। বিধান ও তাঁর বাহিনীর দাপট অব্যাহত ছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকারের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। ২০০৪ সালে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ শুরু হলে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। এর মধ্যে মাথা মুড়িয়ে গায়ে গেরুয়া কাপড় চাপিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু সেজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়েছেন অনেক দিন। কিন্তু তাঁর ছদ্মবেশ ধারণের কথা জানাজানি হয়ে গেলে ভুয়া পাসপোর্ট বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে যান তিনি। প্রশ্ন ওঠে এখানেও। একটি পাসপোর্ট তৈরির জন্য সাধারণ একজন নাগরিকের কত ঝামেলা পোহাতে হয়, ভুক্তভোগীমাত্রই তা জানেন। সেখানে ইউসুফ আলী নাম দিয়ে বিধান বড়ুয়া এত সহজে পুলিশি তদন্ত পেরিয়ে পাসপোর্ট পেলেন কী করে? তদুপরি মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশিদের জন্য দুর্লভ চাকরির বাজারে দক্ষতা-যোগ্যতাহীন বিধানের একটি শিপিং কোম্পানিতে চাকরিই বা জুটে গেল কী করে?
কোনো ‘প্রভুর’ পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই প্রক্রিয়াগুলো সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়েছে—এ কথা বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন। ঝুঁকি নিয়ে বিধানের দেশে ফিরে আসায় তাই সন্দেহের উদ্রেক হয়—সেই ‘প্রভুর’ বিপদের দিনে ঋণ শোধ করতে ফিরে আসেননি তো তিনি?
বিধান সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ২০ বছর আগে সন্ত্রাসের রাজনীতি থেকে সরে আসতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পার্টি ছাড়লে মৃত্যু অবধারিত জেনে পারেননি। হাতের কাছে অনেক উদাহরণ থাকলেও বিধান বড়ুয়ারা বুঝতে পারেন না—এটা এমনই এক চক্রব্যূহ, যেখানে ঢোকার পথটি যত সহজ, বেরিয়ে আসার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর বেরিয়ে আসার আর কোনো পথ না পেলে এ রকম অনেক সন্ত্রাসীর কাতরতা আমরা শুনেছি, ‘ভালো হতে চাই’।
এ মুহূর্তে মনে পড়ছে জাতীয় পার্টি আমলের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর পোষ্যগুন্ডা আবদুর রহিম ওরফে আবদুইয়ার কথা। হাটহাজারী এলাকায় খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অগ্নিসংযোগ—হেন কোনো দুষ্কর্ম নেই যা করেননি এই আবদুইয়া। জাতীয় পার্টির পতনের পর দীর্ঘকাল পালিয়ে বেড়িয়েছেন। তাবলিগ জামাতে যোগ দিয়ে ধর্মে-কর্মে মন দিয়েছিলেন। এলাকায় ফিরে এসে তাঁর ভালো হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছিলেন প্রকাশ্যে। কিন্তু নিয়তি তাঁকে ছাড়েনি—আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন আবদুইয়া। তাঁর পৃষ্ঠপোষক কিন্তু আছেন বহাল তবিয়তে, এখন তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।
গিয়াস হাজারিকা নামের আরেক সন্ত্রাসী ও অস্ত্র ব্যবসায়ীর পরিণতি ছিল আরও করুণ। একসময় গায়ক হিসেবে তাঁর কিছুটা খ্যাতিও হয়েছিল।
চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমীতে একটি অনুষ্ঠানে গান করার পর বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীরা অনেকেই উপমহাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে তাঁর কণ্ঠের তুলনা করেছিলেন। উদ্দীপিত শিল্পী তখন নিজের নামের কিছু অংশ পাল্টে গিয়াস হাজারিকা নাম নিয়েছিলেন। কিন্তু সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কারণে সেই নামটি ব্যর্থ হয়ে গেল। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কিছুদিন জেলে ছিলেন তিনি। ছাড়া পেয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ভালো হতে চান তিনি—এমনকি সাউন্ডটেক থেকে একটি একক গানের অ্যালবাম প্রকাশের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়াস হাজারিকার শিল্পীজীবনের সাফল্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমাদের। ক্রসফায়ারে মরতে হয়েছিল তাঁকে।
এ গল্প অসংখ্য তরুণের। কিন্তু গল্প শেষের নীতিকথাটি মনে রাখবে কে?
বিধানের পরিণতি কী হবে, এখনো তা আমরা জানি না। শুধু জানি, নষ্ট রাজনীতিকদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থেকে যাঁরা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ভাবেন, মৌচাক ভেঙে গেলে তাঁদের জীবন খড়কুটোর চেয়েও তুচ্ছ!

২.
নগরের পাথরঘাটা এলাকায় গত ১১ সেপ্টেম্বর একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের সংঘর্ষ ঘটে গেল। এতে সাংবাদিকসহ আহত হয়েছেন ৩০ জন। অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। পরে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এলাকাবাসী কেউ বলছেন, লক্ষ্মী পূজা উপলক্ষে এক কিশোরের পটকা ফোটানো থেকে—কেউ বলছেন, স্থানীয় মাঠে ক্রিকেট খেলা নিয়ে দুই পক্ষের ঝগড়া থেকে এর সূত্রপাত। কারণ যা-ই হোক, তা যে বড় সংঘর্ষের বিষয় হতে পারে না, এতে দ্বিমত নেই কারও। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পুরো ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে একটি মহল, যা প্রায় হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষে রূপ নিতে যাচ্ছিল। নগরের অন্যান্য এলাকায় ফোন করে লোকজনকে উত্তেজিত করার খবরও পাওয়া গেছে। আপাতত সামাল দেওয়া গেছে পরিস্থিতি। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা থেকে এই বার্তাটি পাওয়া গেল—একটি মহল যেকোনো অছিলায়, তা সে তুচ্ছ ঘটনাই হোক, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পাথরঘাটা জেলেপাড়া-সংলগ্ন ওই এলাকাটিতে এ রকম ঘটনা নতুন কিছু নয়। গত কয়েক বছরে অন্তত চারবার এ রকম ঘটেছে। প্রতিবারই গুজব ছড়ানো হয়, মাইকে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করা হয়। কয়েক বছর আগে একবার নগর মহল্লা সর্দার কমিটির হস্তক্ষেপে নিরসন হয়েছিল এ রকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি।
একই অঞ্চলে বারবার এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ যে আছে তাতে সন্দেহ নেই। সেই কারণটি চিহ্নিত করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট চক্রই যে অব্যাহতভাবে এই অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়টিও প্রায় নিশ্চিত। দোষীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় না আনলে ভবিষ্যতে বড় কিছু ঘটানোর চেষ্টায় থাকবে এই মহলটি।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.