চারদিক-হাতে সাদাছড়ি থাকলে লজ্জার কিছু নেই

মো. জাকির হোসেন বলছিলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আকাশে ভারতের প্লেন উড়তে দেখছি। বউয়ের মুখ দেখছি। ও খুব সুন্দর। কিন্তু পরে সন্তানদের মুখ আর দেখতে পাই নাই। দুই চোখের আলো একবারেই চইলা যায়।’
জাকির হোসেন বলতেই থাকেন, ‘আমি অন্ধ বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। আমি কত যে অসহায়, তা বুঝি।


আমার মতো অন্য যারা, তারাও অসহায়। তবে হাতে একটি সাদাছড়ি থাকলে নিজেকে আর অসহায় মনে হয় না। যাদের চোখ আছে, তারাও তখন আমাদের দেখলে সচেতন হয়।’
জাকির হোসেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের মনে সাহস জোগানোর জন্য ১৯৮৯ সালে সাদাছড়ি তৈরি করেন। এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করা জাকির হোসেন ছড়ি বানানোর কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। বানাতে বানাতে শিখে গেছেন। যাঁর জন্য ছড়িটি বানাচ্ছেন তা ৪২ ইঞ্চি না ৪৫ ইঞ্চি বানাবেন, শিশুদের জন্য হলে তা ৩৬ ইঞ্চি না অন্য কোনো মাপের হবে, ছড়ি যিনি ব্যবহার করবেন তা ব্যবহারকারী পকেটে রাখবেন না হাতে রাখবেন, সে চিন্তাও করেন।
পুরান ঢাকার নবাবপুর থেকে লম্বা অ্যালুমিনিয়ামের লাঠি কেনা, মেশিনে সে লাঠি বিভিন্ন মাপে কাটা, কাটা টুকরোগুলো জোড়া দেওয়াসহ পুরো কাজই তিনি নিজ হাতে করেন। স্ত্রী রাবেয়া ও ছেলেমেয়েরাও বর্তমানে কাজটি শিখে ফেলেছেন। বয়স হওয়ায় জাকির হোসেনের কাজে পরিবারের সদস্যরা হাত লাগান। প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবসের আগে জাকির হোসেনের খোঁজ পড়ে। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর, বিভিন্ন এনজিও সেই সাদাছড়ি কিনে নেয়। তবে জাকির হোসেন সরকারের কাছ থেকে তাঁর কাজের স্বীকৃতি পাননি আজও। পাননি কোনো অনুদান।
১৯৪০ সালে মুন্সিগঞ্জে জাকির হোসেনের জন্ম। জীবনের অনেকগুলো বছর চোখে দেখেছেন। তবে রাতে চোখে দেখতেন না। সন্ধ্যায় সবাই ঈদের চাঁদ দেখলেও জাকির হোসেন তা দেখতে পেতেন না। আস্তে আস্তে চোখের সবটুকু আলোই নিভে যায়।
সাদা ধবধবে দাড়ি, মাথার সাদা চুলই বলে দিচ্ছে জাকির হোসেনের বয়স হয়েছে। তবে সাদাছড়ি হাতে না থাকলে বোঝার উপায় নেই তিনি চোখে দেখেন না। জাকির হোসেন বলেন, ‘অনেকেই সাদাছড়ি হাতে নিতে লজ্জা পায়। লজ্জার কিছু নেই। আমার হাতের ছড়ি দেখে সমাজের অন্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করবে। বাসের চালকই গাড়ি থামাবে।’
মিরপুর ১ নম্বরের জি ব্লকে জাকির হোসেনের দোতলা বাড়িটির বিভিন্ন অংশে ফাটল ধরেছে। বাড়িটি পেয়েছেন একটি এনজিও থেকে। বাড়িতে জিনিসপত্রের আধিক্য নেই। তবে সাদাছড়ি বানানোর উপকরণ, প্যাকেট করা বানানো ছড়ি, ছড়ি বানানোর মেশিন বাড়ির বেশির ভাগ জায়গা দখল করে রেখেছে।
জাকির হোসেন বলেন, ‘চোখে দেখি না। একদিন একটি এনজিওতে গিয়ে শুনি, কয়েকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলছে, সাদাছড়ি না পেলে চেয়ারম্যানের পিঠের চামড়া তুলে নেবে। মনে মনে বললাম, কী এত মূল্যবান জিনিস যে এর জন্য চেয়ারম্যানের পিঠের চামড়াই তুলে ফেলতে চাচ্ছে? তারপর আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম।’
এরপর আছে আরেকটি ঘটনা। জাকির হোসেন বলেন, ‘একটি সংস্থা থেকে আমাকে বিনা মূল্যে ছড়ি দেওয়ার কথা ছিল। সংস্থাটির কাছে এই ছড়ির জন্য ছয় মাস ধরনা দিতে হয়। সংস্থাটি একটি ছড়ি হাতে দিয়েও ৬০০ টাকা না দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত তা দেয়নি। মনে ব্যথা পাই। এর গুরুত্বও বুঝতে পারি। তখনই সাদাছড়ি তৈরির চিন্তা মাথায় ঢোকে।’
জাকির হোসেনের দুই ছেলে বিদেশে থাকেন। এক ছেলে দেশেই ভালো চাকরি করছেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মেয়ের জামাইও ভালো চাকরি করছেন। তিনি পেটের দায়ে সাদাছড়ি তৈরি করছেন না। জাকির হোসেনের স্ত্রী রাবেয়া বলেন, ‘বয়স হইছে। তার পরও মানুষটা পরিশ্রমের কাজটি করা ছাড়ে না। নেশা হইয়া গেছে।’
জাকির হোসেনও একমুখ হাসি নিয়েই বললেন, ‘সাদাছড়ি না বানালেও চলে। একসময় সাদাছড়ি বিদেশ থেকে আনতে হতো। অনেক দাম পড়ত। আর আমি একেকটা ছড়ি ১৭০ টাকা বা আরও কম দামে বিক্রি করি। গত বছর আরেকজন ছড়ি বানানোর উদ্যোগ নিছে বইলা শুনছি। সরকার এখনো ছড়ি বানায় না। কিন্তু আমি দেশের সব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর হাতে সাদাছড়ি দেখতে চাই। তাই পরিশ্রম করতাছি।’
জাকির হোসেন বলেন, ‘কেউ যদি আইস্যা বলে, আমার চোখের আলো ফিরাইয়া দাও, তা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একটি সাদাছড়ি তো তার হাতে তুইল্যা দিতে পারি। এটা খুবই দরকার। বিষয়টা নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাও জরুরি।’
জাকির হোসেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পড়াশোনার জন্য ব্রেইলের উপকরণ, অঙ্কের বোর্ডসহ বিভিন্ন উপকরণও ঘরে বসেই তৈরি করছেন।
কখনো যদি চোখে দেখার সুযোগ পান, তাহলে প্রথমেই কোন জিনিসটি দেখতে চাইবেন জানতে চাইলে জাকির হোসেন এক মুহূর্তও চিন্তা না করেই বললেন, ‘আমি সব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর হাতে একটি করে সাদাছড়ি দেখতে চাই।’
মানসুরা হোসাইন

No comments

Powered by Blogger.