বাজার-পরিস্থিতি-ওএমএস এবং নিম্নমধ্যবিত্ত by সন্জয় চন্দ্র রায়

ওএমএস (খোলাবাজারে বিক্রি) কার্যক্রম বলতে যা পরিচিত, তা হলো বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্যে সরকার কর্তৃক চাল সরবরাহ। গত কয়েক বছরে মূল্যস্ফীতির দিকে তাকালে দেখব, খাদ্য মূল্যস্ফীতি অন্য যেকোনো ক্ষেত্রের মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি। প্রশ্ন হলো খাদ্য মূল্যস্ফীতি হিসাবের সময় কি শুধু চালের মূল্যবৃদ্ধিকেই হিসাব করা হয়?


ডাল, লবণ, তেল, সবজি কি খাদ্যতালিকায় পড়ে না? তাই আমি মনে করি, বাংলাদেশের বর্তমান বাজার বাস্তবতায় ওএমএস কার্যক্রমকে শুধু চাল বিক্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে উপরিউক্ত পণ্যগুলোও প্যাকেজ আকারে বিক্রি করা যায়।
বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার কার্যক্রমের মধ্যে ওএমএস একটি। ‘সকল উন্নয়নকাজ বন্ধ রেখে খাদ্য আমদানি করা হবে’—প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তির মধ্য দিয়েই তা স্পষ্ট। কার্যক্রমটি রাজনৈতিক-অর্থনীতির সঙ্গেও সম্পর্কিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওএমএসের চাল নিতে আসা মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সরেজমিনে দেখেছি, ওই কার্যক্রমের শুরুতে সুবিধাভোগী ছিল শুধু হতদরিদ্ররা। বর্তমানে নিম্নমধ্যবিত্তরাও যুক্ত হয়েছে এর সঙ্গে। নিম্নমধ্যবিত্তদের লাইনে যুক্ত হওয়ার কারণ হতে পারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। কারণ, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের সত্যতা খুঁজতে গিয়ে দুই ধরনের উত্তর পেয়েছি: এক. ক্রয়ক্ষমতা খুব বেশি না কমলেও সঞ্চয়ের প্রবণতার কারণেই নিম্নমধ্যবিত্তরা বাজার থেকে ৩৬-৩৮ টাকা দরে চাল না কিনে একই গুণগত মানসম্পন্ন চাল ২৪ টাকা দরে খোলাবাজার থেকে কিনছে। এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, সঞ্চয়ের প্রবণতা গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্তেরই বেশি, যা তত্ত্বগতভাবেও সঠিক।
দুই. নিম্নমধ্যবিত্তরা ওএমএস কার্যক্রমের শুরুর দিকে লাইনে দাঁড়িয়ে চাল সংগ্রহের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। কিন্তু বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে।
নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরাই মুক্তবাজার অর্থনীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে দিনের পর দিন। কারণ, এই মানুষেরা যেমন রাস্তায় দাঁড় করাতে পারে না, তেমনি বাজারে প্রচলিত দামের কাছেও দাঁড়াতে কষ্ট হয়।
ওই শ্রেণীর মানুষ তথ্য দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেউই নাম বলতে রাজি হয়নি, ঠিকানা বলতে রাজি হয়নি কিংবা কথা বলার সময় মাথার ঘোমটা এমনভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে, যাতে আমি চেহারা চিনতে না পারি। ব্যাপারটি বুঝতে পেরে তাদের বললাম, বাজার দামের কাছাকাছি দামে যদি ঠেলাগাড়ি বা ভ্যান থেকে সবজি, পেঁয়াজ কিংবা আম কিনতে পারি, তাহলে ট্রাক থেকে চাল কিনতে লজ্জা পাব কেন? যেখানে প্রতি কেজিতে ১২-১৪ টাকা লাভ হচ্ছে। জানি না কতজনকে আমি বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম বা কতজন তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
বর্তমান বাস্তবতায় গ্রাম ও শহরের অর্থনীতির পার্থক্য সুস্পষ্ট। গ্রামের একজন রিকশাচালকের সঙ্গে শহরের একজন রিকশাচালকের আয়ের পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। কারণ, শহরের একজন রিকশাচালক নিজেই শুধু উপার্জন করেন না, স্ত্রীসহ সন্তানেরাও তাঁর আয়ের উৎস, যা গ্রামের রিকশাচালকের নেই। কিন্তু বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা ওই দুই রিকশাচালকের প্রায় কাছাকাছি। এ জন্য জীবনযাত্রার মান তুলনামূলকভাবে শহরের রিকশাচালক বা নিম্ন আয়ের মানুষেরই বেশি।
কিন্তু ওএমএসের যে সহযোগিতা, তা শহরজুড়ে চোখে পড়ার মতো হলেও গ্রামের দরিদ্র শ্রেণী এর সুফল তেমন পাচ্ছে না। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার তার শাসনামলে ১০ শতাংশ দারিদ্র্য হ্রাস করেছে, এটি সত্য ধরে নিলেও গ্রামীণ দারিদ্র্য কত শতাংশ হ্রাস করতে পেরেছে, তা নিয়ে সংশয় আছে। এ জন্য আমি মনে করি, গ্রামীণ এলাকায় ওএমএস কার্যক্রম জোরদার করা অতি জরুরি।
‘খাদ্যনিরাপত্তা’ সাম্প্রতিক বিশ্বের আলোচিত বিষয়। জনসংখ্যার চাপ একদিকে যেমন খাদ্যের চাহিদা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে খাদ্যের জোগান আশানুরূপভাবে বাড়ছে না প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে। যে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের দাম প্রায়ই অস্থিতিশীল থাকে। আবার ‘আন্তর্জাতিক রাজনীতির’ একটি হাতিয়ার হলো খাদ্য। তাই অধিকাংশ দেশ ‘খাদ্যনিরাপত্তা’কে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশকেও দিতে হবে।
আমি মনে করি, ওএমএস স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশে ‘ব্যক্তিগত খাদ্যনিরাপত্তা’কে নিশ্চিত করছে বা করবে। তবে ‘দীর্ঘ মেয়াদে সামষ্টিক খাদ্যনিরাপত্তা’কে নিশ্চিত করতে হলে আমদানি বাড়িয়ে ওএমএসকে মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে (চাহিদা ও জোগানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় দ্রব্যের দাম নির্ধারিত হয়) চালের বাজার যেখানে প্রায়ই অস্থিতিশীল থাকে, সেখানে দেড় বা দুই বছর ধরে ২৪ টাকা দরে চাল বিক্রি করতে গিয়ে সরকারকে অনেক টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সত্য, কিন্তু ভবিষ্যতে ২০০৯-২০১৩ শাসনামলকে মূল্যায়ন করতে গেলে কৃষি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি খাদ্য মন্ত্রণালয়কেও যুক্ত করতে হবে।
তাই আমি মনে করি, ওএমএসের মাধ্যমে বিক্রীত চালের মূল্য কিছুটা বাড়িয়েও যদি ক্ষমতার পুরো মেয়াদে অব্যাহত রাখা যায়, তাহলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দায়ভার কিছুটা হলেও ঘুচবে।
সন্জয় চন্দ্র রায়: প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

No comments

Powered by Blogger.