যুক্তরাষ্ট্র-ইরানি ‘ষড়যন্ত্র’ by আলেকজান্ডার ককবার্ন

খুবই সরল নিয়ম: প্রথমে সরকারি তরফে চরম উদ্ভট অভিযোগ তোলা হবে, মত তৈরির প্রধান ক্ষেত্রগুলোতে এগুলো নিয়ে কোনো ভিন্নমত আসবে না। ধরুন, সিআইএ এজাতীয় নিরাপত্তা পর্যালোচনা প্রতিবেদনের একটি অংশ ফাঁস করল যে চাঁদ আসলে পনিরের তৈরি এবং সেটা খেয়েফেলতে চীন জৈবপ্রযুক্তিতে বানানো এক জোড়া দানবীয় ইঁদুর পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। এতে করে চাঁদের অন্ধকার পিঠে মিসাইল প্রতিরক্ষা রাডার স্থাপনের মার্কিন পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।
এ খবরের শিরোনাম প্রথমে এভাবে লেখা হবে, ‘চীনা ইঁদুরের হুমকি নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ: অনেকের অবজ্ঞা’। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এ এ-বিষয়ক সংবাদে সন্দেহকারীদের ভাষ্য দেওয়া হবে। কিন্তু এগুলোকে খারিজ করার জন্য খুব ভক্তিভরে ‘গোয়েন্দা সূত্র’, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, থিংকট্যাংক ‘বিশেষজ্ঞ’সহ অনেকের কথাবার্তাও দেওয়া থাকবে। এঁরা সরকারি ভাষ্যের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলবেন, ‘ইঁদুর বিষয়টি মনে হচ্ছে গুরুতর’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কয়েক দিনের মধ্যেই খবরের কাগজের বরাতে ঘটনাটি মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপারে পরিণত হবে। খবরের মোড় এরপর ঘুরে যাবে চীনা ইঁদুরের হুমকি মোকাবিলায় মার্কিন সরকার কী ভাবছে, তার আলোচনায়। যেমন: ‘মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘সব পথই খতিয়ে দেখা হচ্ছে’ ইত্যাদি। এমনটাই যে ঘটে, তার প্রমাণ পেতে সৌদি রাষ্ট্রদূত হত্যার জন্য ‘ইরানি ষড়যন্ত্র’ বিষয়ে দুনিয়াজুড়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো খতিয়ে দেখতে পারেন।
এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা খুব পাতলা হলেও তথাকথিত ইরানি ষড়যন্ত্রের অভিযোগটি একেবারেই হাস্যকর। কী কারণে ইরান সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করবে? এর মানে খোলাখুলি যুদ্ধ ডেকে আনা। কিন্তু ইরান এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো যুদ্ধ চায় না।
টেক্সাস-নিবাসী মানসুর জে আর্বাসিয়ার নামের ইরানি বংশোদ্ভূত এক পুরোনো গাড়ি-বিক্রেতাকে প্রধান ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে মেক্সিকোর মাদকচক্র লস জেটাকে সৌদি রাষ্ট্রদূতকে হত্যার জন্য দেড় মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ঘটনায় যদি অনেক মানুষ মারা যায়, তাদের মধ্যে কোনো মার্কিন সিনেটর থাকলেও নাকি অসুবিধা নেই বলে জানিয়েছেন আর্বাসিয়ার। ইসরায়েলি দূতাবাসেও হামলার প্রস্তাব নাকি ছিল তাঁর।
ওয়াশিংটনে সন্ত্রাসী বোমায় কোনো মার্কিন সিনেটর মারা গেলে কিংবা ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনে পটকার থেকে বড় কিছু ফাটলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন বিমানগুলো ইরানি টার্গেটে বোমার বৃষ্টি বইয়ে দেবে। কী কারণে ইরান এমন জিঘাংসা ডেকে আনবে?
আবারও বলছি: ইরান আমেরিকার সঙ্গে কোনো যুদ্ধ চায় না; বরং বিপরীতটাই সত্য। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ সম্প্রতি পরমাণু-সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি কিছুটা কমিয়ে আনার বদলে আমেরিকার কাছ থেকে কিছু পারমাণবিক জ্বালানি পাওয়ার চেষ্টা করছেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন লিখেছে, আমেরিকা প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখছে। ষড়যন্ত্রের অভিযোগের জন্য সম্পর্ক ভালো করার পুরো প্রচেষ্টাটাই ভেস্তে গেল। গত বুধবার ওবামা মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেলের বুনো অভিযোগগুলো সমর্থন করে ইরানের বিরুদ্ধে আরও কঠিন অবরোধ চাপানোর হুমকি দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের মাত্র দুটি শক্তি যুদ্ধ চায়—ইসরায়েল ও সৌদি আরব। তারা চায় আমেরিকা ও ইরানের মধ্যকার ফাটল আরও চওড়া হোক।
অদৃশ্য থেকে কাজ করার দক্ষতার জন্য ইরানি গোয়েন্দাদের সুনাম আছে। কোনো প্রমাণ নেই, তবু অনেকে বিশ্বাস করে, ১৯৮৮ ইরান তাদের একটি যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংসের প্রতিশোধ হিসেবে মার্কিন প্যানঅ্যাম বিমান ধ্বংস করেছিল। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও অদৃশ্য ‘ষড়যন্ত্র’ আবিষ্কার করে ফায়দা তোলায় বেশ পাকা। ১৯৮১ সালে তারা অভিযোগ করে যে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানকে হত্যার জন্য লিবীয় ‘খুনী দল’ কানাডা সীমান্তের সুড়ঙ্গ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকেছে। এর কোনো প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন মার্কিন কর্তৃপক্ষ বোধ করেনি। কিন্তু এর জের ধরে পাঁচ বছরের মাথায় কর্নেল গাদ্দাফির বাসভবনে বিমান হামলা হয়।
১৯৯৩ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশের বাবা বুশ সাদ্দামের বিজয় অনুষ্ঠানে শামিলহতে কুয়েত সফর করেন। কুয়েতি কর্তৃপক্ষ তখন গাড়িবোমার মাধ্যমে তাঁকে হত্যার ‘ষড়যন্ত্রের’ কথা প্রকাশ করে। যথারীতি এফবিআই ঘোষণা করে, বোমাটির তার পেঁচানোর ধরন থেকে তারা নিশ্চিত যে কাজটা ইরাকি গোয়েন্দাদের।
জাতিসংঘে মার্কিন প্রতিনিধি বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে তোলেন এবং প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ইরাকি গোয়েন্দা সংস্থার সদর দপ্তরে ২৩টি টমাহক মিসাইল নিক্ষেপের নির্দেশ দেন। এর একটি বাগদাদের এক আবাসিক এলাকায় পড়লে জনপ্রিয় ইরাকি শিল্পী লায়লা আল-আত্তারসহ অনেকে নিহত হন। এ ঘটনাই ক্লিনটন আমলে ইরাকের সঙ্গে সম্পর্ক বিষিয়ে তোলে।
মার্কিন গোয়েন্দা ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা মনগড়া ষড়যন্ত্রে বিশ্বাস করার জন্য মুখিয়ে থাকেন। গত বছর আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর প্রধান জেনারেল পেত্রাউস তালেবানের সঙ্গে সংলাপের জন্য মোল্লা আখতার মোহাম্মদ মনসুর নামের এক কথিত তালেবান-নেতার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর খবর: ‘মনসুরের পরিচয় নিশ্চিত করতে তাঁর ছবি বন্দী তালেবানদের দেখিয়ে নিশ্চিত হয়, এই লোকই মনসুর।’
পরে জানা যায়, তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা করিয়েদিতে বিপুল টাকা খাওয়া লোকটি আসলে ভণ্ড। খেয়াল করবেন, ইরানি ষড়যন্ত্রের বেলায়ও এফবিআই নিশ্চিত করে বলেছে, ওই আর্বাসিয়ার লোকটি ইরানি এক সামরিক কর্মকর্তার ছবি দেখে চিনতে পেরেছে।
প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র সরকার কেন কথিত ইরানি ষড়যন্ত্রের বিষয়ে এত উচ্চবাচ্য করছে? আগেও দুটি ক্ষেত্রে তারা এ রকম অভিযোগ নিয়ে মেতেছিল, যার পরিণতি ছিল যুদ্ধের জন্য অছিলা সৃষ্টি করা। প্রথমটি হলো, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ২০০৩ সালে গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুদের নিশ্চিতকারী কুখ্যাত দলিলটির খবর জাতিসংঘে পেশ করেন। পরে এর সবই ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয় অভিযোগ তোলেন পরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত সুসান রাইস। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁরা ঘোষণা করেন, গাদ্দাফি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন এবং নিজ জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছেন। অথচ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্পষ্ট গলায় অভিযোগটি খারিজ করে দেয়।
মার্কিন বিচার বিভাগের অভিযোগ মানে সরকারি অভিযোগ। ইরান আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ-তৃষ্ণার আলামত হিসেবে ‘ইরানি ষড়যন্ত্র’ দাঁড়িয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, এই অভিযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কত দূর যাবে? আমেরিকার অতি দুর্বল প্রেসিডেন্ট সাহেব আরেকবার নির্বাচিত হওয়ার জন্য ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।

কাউন্টারপাঞ্চ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
আলেকজান্ডার ককবার্ন: মার্কিন বিশ্লেষক, কাউন্টারপাঞ্চ-এর সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.