জনশক্তি খাতে একক ও দলগত ভিসা বিতর্ক by হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

দিনে দিনে প্রবাসী আয় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, প্রবাসী আয় বা ফরেন রেমিট্যান্স প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী। দেশের অর্থনীতিতে চলমান সংকট নিয়ে যখন বিষয় বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত, সরকার যখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে, তখন রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে প্রবল এক আশা জাগানিয়া উপলক্ষ। মনে পড়ে বছর কয়েক আগের কথা।


ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন ক্ষমতায় এসে চারদিকে মহারণ শুরু করল, তখন আমরা দেখলাম অর্থনীতির এক করুণ দশা। চারদিকে কেবলই হাহাকার। মুদ্রাস্ফীতির দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়তেই থাকল। বাজারদর নাগালের বাইরে চলে গেলে সাধারণ মানুষ হাঁসফাঁস করতে লাগল। শেষমেশ আমরা দেখলাম, সে সময়ও আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের উপার্জিত টাকা পাঠানোর কারণেই কেবল অর্থনীতির চরম দুর্দিন সামাল দেওয়া গেল।
দেশের অর্থনীতি যখন অস্থির, তখন আমরা আবারও দেখছি অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ আমাদের আশান্বিত করছে। প্রবাসীদের আয় ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। প্রবাসী আয়সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত রিপোর্ট দেখলেই আমরা বুঝতে পারি, প্রবাসী আয় কতটা ঊর্ধ্বমুখী, যা অর্থনীতির জন্য খানিকটা হলেও সুবাতাস বয়ে নিয়ে আসছে, অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের সর্বশেষ জানুয়ারি মাসেও এই বেড়ে চলাটা দারুণভাবে অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ মাসে এই বেড়ে চলাটা এতটাই ঊর্ধ্বমুখী যে গত জানুয়ারি মাসে ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রবাসীরা ১২১ কোটি ৫৮ লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন_যা নাকি একক মাস হিসেবে এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। শুধু এই প্রবাসী আয়ের প্রবাহ গত বছরের সঙ্গে এ বছরের ছয় মাসের তুলনামূলক চিত্র থেকেও দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রবাসী আয় ছিল ৬৫২ কোটি ২০ লাখ ডলার। অন্যদিকে এবারের অর্থবছরে আয় দাঁড়িয়েছে ৭২৮ কোটি ২০ লাখ ডলার।
দেশে প্রবাসী আয় যখন বেড়েই চলেছে, তখন আমাদের জনশক্তি রপ্তানির বাজার নিয়ে আবার নতুন এক বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিতর্কটা অপ্রাসঙ্গিক কিছু নিয়ে নয়, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে। বলা হচ্ছে, সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিয়েছে, একক ভিসা নিয়ে আর বিদেশে যাওয়া যাবে না কাজের জন্য, কেউ বিদেশে গেলে তাঁকে অবশ্যই দলগত ভিসায় যেতে হবে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছে, এ নিয়ম নতুন এক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করবে। অর্থাৎ ব্যক্তি উদ্যোগে কাজের অনুমতি পেতেও এখন থেকে ওই দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস বা হাইকমিশন থেকে নিয়োগসংক্রান্ত সব কাগজপত্র সত্যায়িত করাতে হবে। তা না হলে কর্মীরা কোনোভাবেই চাকরি নিয়ে বিদেশে যেতে পারবেন না। কাজের জন্য বিদেশগামীদের জন্য এ এক নতুন বিপত্তি। বিশেষজ্ঞদের মতে, জটিলতার এই ফ্যাঁকড়ায় পড়ে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নামবে। কেননা একক ভিসার নামেই প্রায় ৭০ শতাংশ শ্রমিক কাজের জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ লাভ করে। আগে দলগত ভিসায় বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রেই কেবল সত্যায়নের প্রয়োজন হতো। নতুন এই নিয়মের প্রতিবাদ জানিয়েছে জনশক্তি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বায়রাও।
এদিকে এ নিয়ম বাতলানোর পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে, একক ভিসায় প্রচুর লোক বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেলেও সেখানে প্রতারণার এক বৃহৎ ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। সেই ফাঁদে পড়ে দেশের গ্রামগঞ্জের বিপুলসংখ্যক লোককে যারপরনাই কষ্ট করতে হচ্ছে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে কেউ কাজ পাচ্ছে না, কেউ কাজ পেলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছে না। এক ধরনের রিক্রুটিং এজেন্সি শুধু বিদেশে ঠেলে লোক পাঠালেও তাদের বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য অধিকারের বিষয়ে সচেতন নয়। ব্যক্তিগত ভিসা দেখিয়ে বিএমইটি ছাড়পত্র নেওয়ার কারণে জনশক্তি রপ্তানিকারকের জবাবদিহিতার জায়গা খুবই দুর্বল। ফলে শুধু এই একক ভিসার কারণেই বিদেশে কর্মরত কর্মীরা নানা প্রক্রিয়ায় শোষণ-বঞ্চনা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যার নির্মম খেসারত দিতে হয় অভিবাসী শ্রমিকদের। অনেককে তাই দিনের পর দিন বিদেশে অবস্থান করেও কোনো ধরনের সঞ্চয় ছাড়াই দেশে ফিরে আসতে হয়।
মন্ত্রণালয় বলছে, জনশক্তি সেক্টরে তারা মোটেও কোনো ধরনের খবরদারিমূলক অবস্থা তৈরি করছে না। তবে তারা এই সেক্টরে এমন একটি ধারা বা পরিবেশ তৈরি করতে চায়, যাতে সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই যেন প্রতারণার শিকার না হয়। একই সঙ্গে অভিবাসন ব্যয়ও যেন যেমন ইচ্ছা তেমন করে লাফিয়ে উঠতে না পারে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় মূলত এখানে একটা জবাবদিহিমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়, যা থেকে সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। জনশক্তি রপ্তানিতে এক ধরনের সুশৃঙ্খল অবস্থা এবং আস্থার জায়গা তৈরি হবে বলে তাদের বিশ্বাস। এ কথা সত্য, আজকে আমরা গর্বের সঙ্গেই বলছি, আমাদের প্রায় ৮০ লাখ মানুষ যাঁরা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে, শরীরের রক্ত পানি করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। কিন্তু এখানে দীর্ঘশ্বাসের পাহাড়ও কম না। বিদেশে যাওয়ার পর চাকরি না পাওয়া, বেকার হয়ে দিনের পর দিন বসে থাকা, আবার চাকরি পেলেও নামকাওয়াস্তে বেতন, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বেতন না দেওয়া, অভিবাসন ব্যয়ের জন্য উপার্জনের বড় অংশ কথিত মধ্যস্থ শ্রেণীর পকেটে চলে যাওয়া_এ রকম আরো অনেক সমস্যা আমাদের জনশক্তি রপ্তানির আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। একই সঙ্গে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ের ঝুঁকি তো রয়েই গেছে। এক শ্রেণীর কথিত অতি মুনাফালোভী এজেন্সি রয়েছে যারা অনেক বেশি টাকা নিয়ে বিভিন্ন দেশে লোক পাঠিয়ে থাকে। বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একজন শ্রমিক এ ধরনের এজেন্সি মারফত যে পরিমাণ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে যান, সেই টাকা তুলতেই তাঁর কমপক্ষে তিন-চার বছর লেগে যায়। জনশক্তি খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলমান এসব সমস্যা সমাধানে বর্তমান প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী বরাবরই সক্রিয় রয়েছেন। সেই সক্রিয়তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নতুন নিয়মেও।
এখানে একটি বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট যে মন্ত্রীর জনশক্তি খাত নিয়ে সার্বিক যে ইনটেনশন সেটি অবশ্যই ভালো। তিনি সব সময়ই এই খাতে ব্যবস্থাপনা দিকের উন্নতির পক্ষে এবং সাধারণ শ্রমিক যাতে কোনোভাবেই দেশে-বিদেশে দালালচক্র কর্তৃক হয়রানি, প্রতারণার শিকার না হন সে বিষয়ে দারুণভাবে তৎপর। এ কারণেই শুরু থেকেই তিনি এ খাতের বিশৃঙ্খল অবস্থাগুলো ধারাবাহিকভাবে ঠিক করার চেষ্টা করেছেন। মন্ত্রী অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের সেবাপ্রবাহ বাড়িয়ে তিনি মন্ত্রণালয়কে যথেষ্ট গণমুখী করতে পেরেছেন। এই ধারাবাহিকতায় সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা প্রয়োগ হওয়ার পরই কেবল বোঝা যাবে অর্জনটা কোন দিকে এগোচ্ছে। তবে জনশক্তি খাতে অভিবাসী শ্রমিকদের যেকোনো ধরনের হয়রানি যদি সরকারের কোনো নীতি বা নিয়ম প্রণয়নের কারণে প্রশমিত হয়, তাহলে অবশ্যই সেটা অভিনন্দনযোগ্য।
লেখক : জনশক্তি রপ্তানি বিশ্লেষক এবং চেয়ারম্যান,
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondebate@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.