আরো ভালো ছাত্রলীগ by ড. সৌমিত্র শেখর

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৭তম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বৃহত্তম এই ছাত্রসংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। এই সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি নিজেও ছাত্রলীগের নেত্রী ছিলেন।


স্বভাবতই নির্বাচিত নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরদিন সাক্ষাৎ করে তাঁর শুভাশিস গ্রহণ করেছেন। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দেশের লাখ লাখ মেধাবী শিক্ষার্থী, যাঁদের অনেকেই পরে জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। এই শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগ আর একনিষ্ঠ কর্মের আলোয় বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণ করেছে ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর শোষণমুক্তির লড়াই এবং পরে দেশের নানা আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ কথা উচ্চারণ করলে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আর ছাত্রলীগের ইতিহাস যেন একাকার। একাকার বলেই ছাত্রলীগের দায়ও বেশি, এই সংগঠনের প্রতি মানুষের প্রত্যাশাও অনেক। অতীতে অবশ্য কিছু নেতা-কর্মী এই ছাত্রসংগঠনের পতাকাতল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন পতাকা তৈরি করেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, ছাত্রলীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন পতাকার নিচে দাঁড়ালেই মনোবাসনা পূর্ণ হবে, 'শোষণমুক্তি' সম্ভব হবে। কিন্তু শোষণমুক্তি যে কোনো ম্যাজিক পদ্ধতিতে সম্ভব নয়, অল্পদিন পরই হয়তো তাঁরা বুঝেছেন। বুঝে অনেকেই আবার ফিরে এসেছেন প্রাণের সেই সংগঠনে। যাঁরা ফেরেননি, তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা আজ হয়ে গেছে শুকিয়ে যাওয়া ফলের মতোই।
বিবেচনায় আনতে হবে সময় ও সমাজকে। যাঁরা সময় ও সমাজকে বিবেচনায় না এনে অতিবিপ্লবের বুলি ছাড়েন, তাঁরা অতীতেও কিছু করতে পারেননি, ভবিষ্যতেও তাঁদের দ্বারা কিছু হবে বলে মনে হয় না। বিরোধিতা করা সবচেয়ে সহজ, কঠিন হলো নানা বিরুদ্ধতার মধ্যেও প্রত্যাশিত কর্ম সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া। যে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদ প্রত্যক্ষভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যে দেশের সংবিধানে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' থাকার পরও ইসলামী ১২টি দল একত্রে 'ইসলাম রক্ষা'র নামে সারা দেশে টানা ৩০ ঘণ্টা হরতাল আহ্বান করে এবং যে দেশে বামপন্থী দলগুলো কাগুজে বাঘে পরিণত, সে দেশে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাড়া কোটি কোটি উদার মানুষের আস্থা রাখার আর স্থান কোথায়? লক্ষ করার বিষয়, আওয়ামী লীগ সরকারের করা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর (জুলাই ২০১১) বিরুদ্ধে বামপন্থী দলগুলো সমালোচনা করেছে, ইসলামপন্থী দলগুলোও সমালোচনা করে হরতাল দিয়েছে। বামপন্থী দলগুলো বলছে, সংবিধান থেকে 'বিসমিল্লাহ' সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার না করায় সংবিধান ধর্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে; আর ইসলামপন্থী দলগুলোর অভিযোগ হলো, এই সংশোধনের কারণে 'ইসলাম'-এর স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। এ অবস্থায় ইসলামী দলগুলো হরতাল দেয়। এ হরতালের পরিপ্রেক্ষিতে বামপন্থীদের ভূমিকা কী? তাঁদের তো উচিত ছিল হরতালের বিরুদ্ধাচরণ করে নূ্যনতম কর্মসূচি দিয়ে হলেও রাস্তায় নামা। কিন্তু বামপন্থীরা গত ১০-১১ জুলাই ইসলামপন্থী দলগুলোর ডাকা হরতালের ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করেননি। আজ এ দেশে ইসলামপন্থী দলগুলো অনেক শক্তিশালী ও কৌশলী। তারা ভুল বুঝিয়ে সাধারণ মুসলিম সমাজকে সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দিতে পারে। এমনটি হলে আওয়ামী লীগ একক দল হিসেবে করবে কী? সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে তাঁরা সংবিধানকে আরো ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবেন। দেশের এ অবস্থায় তাঁর এই বক্তব্যেই তো নির্ভরতা পাওয়া উচিত। বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, পরিস্থিতি অনুকূলে এলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই সংবিধানের আরো ইতিবাচক সংশোধন করবে। সমালোচকদের মনে রাখা প্রয়োজন, বাহাত্তরের সংবিধান আওয়ামী লীগই দেশবাসীকে উপহার দিয়েছিল। এই সংবিধানের প্রতি আওয়ামী লীগের দরদ অন্যদের তুলনায় স্বভাবতই বেশি থাকার কথা। আওয়ামী লীগকে অযথা বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া উচিত হবে না। আওয়ামী লীগ বিপদগ্রস্ত হলে তাকে রক্ষা করবে কে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে কারা? ইরান বা আফগানিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে যেভাবে গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছে, নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে ব্যক্তির স্বাধীনতা_এখন ধর্মের নামে যারা হরতাল ডাকে বা ডাকছে তারা ক্ষমতায় এলে, ইরান-আফগানিস্তানের চেয়ে কি ভালো হবে এই দেশ? আসলে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী চাইছে দেশকে আরো পিছিয়ে নিতে। তারা আজ বেশ সংগঠিত। স্মরণীয়, নারীনীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকার তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল। সে সিদ্ধান্ত থেকে অনেকটা যে সরে আসতে হলো, তা কেন? কারণ যাঁরা নারীবান্ধব বলে কথার ফুলঝুরি ছোটান, তাঁরা প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখোমুখি হতে ভয় পান বা হননি। নারীনীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল ও ইসলামী দলগুলো যখন হরতাল করে, সেই হরতালের সময় ঘরে বসে কথিত নারীবান্ধবরা টেলিভিশন দেখেন! সুধীসমাজ বা এনজিও নেতা-কর্মী অথবা বামপন্থীরা সর্বাত্মকভাবে মাঠে নামলে এবং জনমত সৃষ্টি করলে সেই হরতালও ব্যর্থ হতো, সরকারও নিশ্চিন্ত হতো আর নারীর অধিকার প্রশ্নে দেশবাসী পেত আরো গুরুত্বপূর্ণ আইন। কিন্তু নারীনীতির প্রশ্নেও আওয়ামী লীগ সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন করার দল বা গোষ্ঠী খুব একটা পাওয়া যায়নি। উচিত তো ছিল নারীনীতির প্রশ্নে (আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন নয়) সারা দেশে কোটি কোটি মানুষের প্রত্যক্ষভাবে এগিয়ে আসা, পথে পথে হাতে হাত রাখা। আশানুরূপ সাড়া দেননি সেই নারীবাদীরা, এনজিও নেতা-কর্মীরা, নারীবান্ধব বলে কথিত বামপন্থীরা। তাই এ কথা মোটেই অত্যুক্তি নয় যে আওয়ামী লীগকে আজও রক্ষা করার অন্য কেউ নেই; তাঁদের নিজেদেরই নিজেকে রক্ষা করতে হবে। আর এই 'নিজেদের নিজে'র মূল অংশ হলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ওপর আস্থা রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। নতুন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন সিদ্দিকী নাজমুল আলম। তাঁরা কাউন্সিলের পরদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে শুভাশিস নিতে গেলে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সংযমী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, অতীতে ছাত্রলীগের অনেক নেতা সংযমী না হয়ে টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন। আসলে এবারের কাউন্সিলে 'আরো ভালো ছাত্রলীগে'র প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের প্রমুখও কিন্তু এবার কাউন্সিলে ছাত্রলীগের সমালোচনা করেছেন রাখঢাক না করেই। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের উদ্দেশে প্রদত্ত তাঁর প্রতিটি বক্তৃতায়ই ছাত্রলীগের সোনালি অতীত স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁদের শাসনও করেন। এই শাসন ও সমালোচনাকে নেতিবাচকভাবে দেখার কিছু নেই_এটা আত্মসমালোচনা। আত্মসমালোচনাই আত্মশুদ্ধির পথ। এই প্রকাশ্য আত্মসমালোচনা প্রত্যেক সংগঠনেই থাকা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, বৃহৎ সংগঠনগুলোতে তা নেই। ছাত্রলীগে আত্মসমালোচনার ধারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, এখন সমালোচনা-আত্মসমালোচনার এই পথ আরো বিস্তৃত ও মুক্ত করা প্রয়োজন। আজ ছাত্রলীগ যে ঊনত্রিশ বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে সীমিত করতে পেরেছে, কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে নেতা নির্বাচন করতে পেরেছে, বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে এটাও কি ইতিহাস সৃষ্টি নয়? বাংলাদেশে আর কোনো সংগঠন নেতৃত্ব নির্বাচনে এই গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় দিতে পেরেছে? এখন সত্যি প্রয়োজন জাতি ও দেশ গঠনের ছাত্ররাজনীতি। ছাত্রলীগের নতুন কমিটির নেতাদের উচিত তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা। আগামী সম্মেলন বা কাউন্সিলের আগে এই কমিটি কী এবং কতটুকু কাজ করল, তাহলে সে মূল্যায়ন করাও সহজ হবে। ছাত্রলীগ ইতিহাস সৃষ্টি করে, আর ইতিহাস সৃষ্টি করেই এগিয়ে যেতে হবে ছাত্রলীগকে। ছাত্রলীগ এগিয়ে গেলেই এগিয়ে যাবে আওয়ামী লীগ, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
scpcdu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.